Sun. May 11th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

মযহারুল ইসলাম বাবলা – খােলা বাজার২৪। রোববার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৮:  দেশের ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার সরকার। এই সরকারের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনে শুনে আমরা যেমন ভারাক্রান্ত, তেমনি সরকার দলীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য নেতা-নেত্রীরাও বোধ করি অবিরাম বলে বলে ক্লান্ত-অবসন্ন। দেশের মানুষের ধারণা এই সরকারের শাসনামলেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত সম্মান-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, পূর্বেকার সকল সরকারের শাসনামলের তুলনায়। দলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হলেও অগণিত দলীয় রাজনীতি মুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঘটেনি। তারই নির্জলা প্রমাণ সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বচনে-ধারণ ও পালনকারী এই সরকারের শাসনামলে ত্যাগী এই মুক্তিযোদ্ধাকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরতে হলো। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের উপার্জনক্ষম কেউ নেই। একমাত্র ছেলে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স শেষে বেসরকারি ওয়ার্ল্ড ইউনির্ভাসিটিতে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়েছে। তাই জটিল রোগে আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার দেশের শীর্ষ দৈনিক সংবাদপত্র, টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের নিকট মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন জানিয়েও সাড়া পায়নি। সরকার নির্বিকার-নির্লিপ্ত, সাহায্যের হাত বাড়ায়নি।

পরিবারের পক্ষে ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায় বহন অসম্ভব বলেই নিরুপায়ে তারা সরকারের সাহায্য কামনা করে, প্রচার মাধ্যমের সহায়তায়। অথচ সরকার কিংবা রাষ্ট্রের ন্যূনতম সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া গেল না। পরিবারের পক্ষ থেকে সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ আর্থিক ব্যয় বহন করলেও, সেটা যথার্থ ছিল না। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে টানা-হেঁচড়ায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় গত ৯ জানুয়ারি রাত ৭.০৫ মিনিটে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মারা গেলেন। ক্ষুব্ধ পরিবার সঙ্গত কারণেই মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘গার্ড অব অনার’ প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনাটি গ্রাম-মফস্বলের ঘটনা নয়। খোদ রাজধানী ঢাকারই ঘটনা।
গত ২০ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডো, লেখক-গবেষক মো. খলিলুর রহমান হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এমআরআই পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন।

এমআরআই পরীক্ষার দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও কাউন্টার অবধি না পৌঁছানোর কারণে তাঁর ছেলে কাউন্টারের ভেতর ঢুকে পিতার মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে কর্তব্যরত একজন ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দরজা আটকে দেন। ছেলেটি উপায়ান্ত না-দেখে পাশের বারডেম হাসপাতালে ছুটে যায়। কিন্তু বারডেমের এমআরআই মেশিন বিকল থাকায় ফিরে আসে। প্রায় চার ঘণ্টা অতিবাহিত হবার পর রোগীর অবস্থার অবনতিতে পরিবারের সদস্যরা নিরুপায়ে রোগীকে নিয়ে ছুটে যায় বেসরকারি পপুলার হাসপাতালে। চারদিন বেসরকারি হাসপাতালের লক্ষাধিক টাকার বিল বহুকষ্টে পরিশোধ করে রোগীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তির সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক আবু সাঈদ খান। সেখানে থাকাবস্থায় সামান্য উন্নতির লক্ষণ দেখা দিলেও কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে সিসিও-তে রাখার পরামর্শ প্রদান করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সিসিও না থাকায় এজন্য রোগীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সিসিও-তে ভর্তির জন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষকে মৌখিক ও লিখিতভাবে ছাড়পত্রে উল্লেখ করেন। দিনমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে সকল দায়িত্বশীলদের কাছে ধরনা দিয়েও ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ ভিসিকে ফোনে অনুরোধ করলে পরদিন রোগীকে সিসিও-তে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সেখানে এই মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ চিকিৎসার পরিচার্যা লাভ ঘটেনি। চারদিন পর রোগীকে বাসায় নিয়ে যাবার ছাড়পত্র দিয়ে কতর্ব্যরত চিকিৎসকেরা দায়মুক্ত হন।

বাসায় আনার পর হতে রোগীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। নিরুপায়ে আবার মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক আবু সাঈদ খানের সহায়তায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির দ্বিতীয় দিনে অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে ডাক্তারেরা তাকে আইসিও-তে দ্রুত স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আইসিও বেড মাত্র দশটি। এবং ঐ দশ বেডে মুমূর্ষু দশজন রোগী থাকায় অগত্যা পরিবারের সদস্যরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের আইসিও-তে রোগীকে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন এবং হাসপাতালে রোগীকে ভর্তির ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ভর্তির আনুষ্ঠানিকতায় প্রায় এক ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হবার পর রোগীকে আইসিও-তে ঢোকানো হয়। চিকিৎসকেরা জানান রোগীকে এখনই ডায়ালিসিস না করালে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। পরিবারের সম্মতিতে প্রথম ডায়ালিসিসের ধকল বহনের ক্ষমতা তখন আর রোগীর না থাকায় অল্পপরেই রোগী মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। তার সামগ্রিক চিকিৎসার প্রকৃত চিত্রটি এরূপই বটে।

চিকিৎসার সহায়তার তাগিদে পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে সচিব জানান, মন্ত্রণালয়ের কাজ নীতি-নির্ধারণ বিষয়ক। একমাত্র যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় সহায়তা প্রদানের অপশন তাদের নেই। সংবাদ ও টিভি মিডিয়ায় আবেদন-নিবেদনেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই সরকারের সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারি হাসপাতাল থেকেও যথার্থ সহমর্মিতাÑচিকিৎসা সেবা লাভও সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘গার্ড অব অর্নার’ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো মো. খলিলুর রহমানের পরিবার প্রত্যাখ্যান করেছে। পরিবারের দাবি এতে সরকার যাতে সচেতন হয়, অন্তত অন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে যেন অনুরূপ ঘটনা না ঘটে সে কারণেই পরিবারের নীরব এই প্রতিবাদ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা চাপা পড়েছে গেরিলা ও সম্মুখ সমরের মুক্তিযুদ্ধের অধিক প্রচারণায়। অথচ বুকে মাইন বেঁধে ডুবুরির বেশে নৌ-কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মংলা বন্দরে নোঙর করা শত্রু জাহাজ উড়িয়ে দিয়েছিল। অপারেশন জ্যাকপট খ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান দৈনিক পত্রিকায়, সাময়িকীতে অবিরাম লিখেছেন। তার ৬টি গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও নৌ-কমান্ডো অভিযান’, ‘মুক্তিযুদ্ধে’, ‘নাবিক ও নৌ-কমান্ডোদের জীবনগাঁথা’, ‘মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান’, ‘সাগর তলে মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’। মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস তার ন্যায় আর কেউ এত ব্যাপকভাবে লিখে যাননি। সেই ইতিহাসের খোঁজে একমাত্র তার রচিত গ্রন্থই একমাত্র সহায়ক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডোদের ইতিহাস জানতে কমান্ডো মো. খলিলুর রহমানের গ্রন্থসমূহের শরণাপন্ন ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
এই মুক্তিযোদ্ধা অক্টোবর, ১৯৭১-এ মংলা বন্দরের সফল অপারেশনের পর খুলনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। যশোর সেনানিবাসে চরম বর্বরোচিত নির্যাতনেও মুখ খুলেননি। প্রায় এক মাস চরম নৃশংস নির্যাতনে মুমূর্ষু অবস্থায় বন্দিদশা থেকে সুকৌশলে নভেম্বরে পালিয়ে ভারতে ফিরে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। সেই নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন আমৃত্য শরীরে বহন করেছেন।

শরীরের ভেতরঙ্গের যে ক্ষতি হয়েছিল বয়সের তারুণ্যে তার প্রতিক্রিয়া তখন না হলেও, বয়স বৃদ্ধির পর ক্রমেই তার কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বয়সের ভারে সে ধকল সামলানো আর তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মাত্র ৬৮ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কোনো রকম সহায়তা ব্যতিরেকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রয়াত হলেন। লজ্জিত-অপমানিত করে গেলেন স্বাধীনতার সুফলভোগীদের এবং হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে গেলেন দেশের সকল মানুষকে। আমাদের স্বাধীনতা যে সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেনি, এই সত্য বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তি তো সুদূরপরাহত। প্রকৃত স্বাধীনতা যদি সকল মানুষকে স্পর্শ করতে পারতো তাহলে একজন ত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে অসহায়ের মতো মরতে হতো না। -আমাদের সময়.কম