Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮: ব্যবসায়ীরা খালেদা জিয়ার রায়ের পর দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন। তাই তারা আগেভাগেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে।

‘আগামী মাসের ৬ তারিখের আগে ক’য় ট্রাক মাল ঢাকা পাডাইতে পারবেন হেই কথা কন। সে হিসাবে টাকা টিটি করম্নম। বাকি মাল ডেলিভারির কথা কমু ১০ তারিখের পর। ৮ তারিখ থাইক্যা দেশে কোন ‘গজব’ নামে আগে হেইড্যা বুইজঝা লই; হ্যার পর বাকি মাল লওনের হিসাব।’

মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী রাজ্জাক মোলস্না এভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে রোববার সকালে দিনাজপুরের এক রাইস মিল মালিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন।

তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আজমল হোসেন জানান, ক’দিন আগে দিনাজপুরের আজাদ রাইস মিলের সঙ্গে তাদের ৪৫ ট্রাক চাল কেনার চুক্তি হয়েছে। ফেব্রম্নয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে পুরো মাল ডেলিভারি দেয়ার কথা। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি হুমকিতে ব্যবসায়ীরা সবাই উদ্বিগ্ন। তাই রায় ঘোষণার ২-৪ দিন আগে-পরে কেউ কোনো মাল ডেলিভারি নিতে কিংবা দিতে চাচ্ছে না। তাই তারা আগেভাগে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চাইছেন।

বাজার সংশিস্নষ্টরা জানান, শুধু চালের বেপারিরাই নন, সব ধরনের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন। তাই ব্যবসায়ীরা সবাই আগেভাগেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনেকটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে। যদিও তা স্বাভাবিকভাবে কারো চোখে পড়ছে না।

অর্থনীতিবিদদের অভিমত, খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক লেনদেনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে এরই মধ্যে এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরম্ন করেছে। যা রাজনৈতিক অস্থিরতার মেয়াদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কতটা দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত পর্যবেক্ষকরা। তাদের ধারণা, খালেদা জিয়া কারাবন্দি হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ বেশখানিকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন হলে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মর্যদা ক্ষুণ্ন হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিকভাবে পড়বে। গোটা দেশ অনিবার্য সংঘাতের পথে এগোবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির ক্ষমতার দাপট দেখানোর পালস্নার সুযোগে জামায়াত তার অস্ত্মিত্ব পুনরম্নদ্ধারে মরিয়া হয়ে ওঠবে। এমনকি জঙ্গি সংগঠনগুলোরও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

বিশিষ্টজনরা বলেছেন, একতরফা নির্বাচন হলে দেশে বড় ধরনের সংঘাত তো বটেই, যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা চিন্ত্মাও করা যাচ্ছে না। আর সত্যিকার অর্থে সে পরিস্থিতি তৈরি হলে তাতে কেবল দেশের জনগণই নয়, বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেও চড়া মূল্য দিতে হবে। দেশের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র এবং জনগণের জান-মাল ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেবে। গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। দেশের অর্থনীতির চাকা এখন শস্নথগতিতে ঘুরলেও তা স্থবির হয়ে পড়ারও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘মনে হচ্ছে বিএনপি ছাড়া একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার উঠে-পড়ে লেগেছে। যদি সেটা হয়, তাহলে তা হবে একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া, যেটা পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে হয়েছিল। এটা করা হলে তা দেশে গ্রহণযোগ্য হবে না, বিদেশেও না। গণতান্ত্রিক কোনো দেশই এটা সমর্থন করবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা করা হলে তা সামাজিক শান্ত্মি বিনষ্টকারী কাজ হবে। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী জেদ ধরেছেন নিজে আবার ক্ষমতায় আসীন হবেন এবং একদলীয় ব্যবস্থার দিকে যাবেন। তবে তার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে পরিস্থিতি অবশ্য অন্যরকম হবে। তা না হলে দেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত্ম হবে। জাতীয় অগ্রগতি বিঘ্নিত হবে। রফতানি স্থগিত হবে। সম্পদ ও প্রাণহানি হবে। সবমিলিয়ে দেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।’

এদিকে ৮ ফেব্রম্নয়ারিকে ঘিরে রাজনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টির শঙ্কায় চরম উৎকণ্ঠায় দিন গুনছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। তারা জানান, নির্বাচনী বছর ঘনিয়ে আসার পরও সরকার ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে কোনো ধরনের সমঝোতার পথ উন্মুক্ত না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ অনেকটা কমে গেছে। ১/১১’র শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেকে অবৈধ ও বৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে প্রয়োজন বড় দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতা। এতদিন ব্যবসায়ীরা সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। অথচ সেদিকে পরিস্থিতি তো এগোইনি, উল্টো বিএনপি চেয়ারপারসনের দুর্নীতির মামলার রায় নিয়ে তা আরও ঘোলাটে হচ্ছে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র এক সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কায় আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। কেননা আন্ত্মর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভর করে ইমেজের ওপর। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোনো দেশে বায়াররা কাজ দিতে চান না। তাই তারা খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি হয় তা পর্যবেক্ষণ করছেন।’

পোশাক শিল্প মালিকরা জানান, ৮ ফেব্রম্নয়ারি পরবর্তী পরিস্থিতি খারাপ হবে এমন আশঙ্কায় অনেক বায়ার তাদের অর্ডার অনুযায়ী কাজ দ্রম্নত রপ্তানি করার তাগিদ দিচ্ছেন। এমনকি অনেকে নির্ধারিত সময়ের আগে শিপমেন্ট চাচ্ছেন। ৮ ফেব্রম্নয়ারি পর পরিস্থিতি বেগতিক হলে সময় মতো মাল পাঠানো যাবে না এ ব্যাপারে শিল্পমালিকদের সতর্ক করছেন। যা নিয়ে এরই মধ্যে পোশাক শিল্পে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেন তারা।

এদিকে আশু পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পরিবহন মালিকরা। তারা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার ঘোষণা দিলেও তাতে কেউ নিরাপত্তা বোধ করছেন না। ১৯১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে-পরে সরকার সাজ সাজ নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করলেও তার মধ্যেই দুষ্কৃতকারীরা বিপুলসংখ্যক যানবাহন ভাঙচুর করে। যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটে।

ঢাকা-কক্সবাজার রম্নটে চলাচলকারী একটি বিলাসবহুল পরিবহনের ব্যবস্থাপক যায়যায়দিনকে জানান, শীতের এ মৌসুমে অনেকে ১০/১৫ দিন আগে বাসের সিট বুক করেন। কেউ কেউ পুরো ভাড়া দিয়ে টিকিট কিনে নিয়ে যান। অথচ ২৫ জানুয়ারি আদালত খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলায় রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করার পর তা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে ৮ থেকে ১০ ফেব্রম্নয়ারি এ সময়ের কোনো টিকিট কেউ বুক করেননি। বরং ২৫ জানুয়ারির আগে ওই সময়ের (৮-১০ ফেব্রম্নয়ারি) টিকিট বুক করে পরে তা অনেকে বাতিল করেছেন। তাদের মত দূরপালস্নার সব পরিবহন ব্যবসায় স্থবিরতার আভাস দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেন ওই পরিবহন ব্যবস্থাপক।

এদিকে খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায় ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও থমকে আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, দেশের রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। যদি দ্রম্নত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মধ্যমেয়াদি সংকটে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

তারা মনে করেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বলতম বিষয় হলো বিনিয়োগ হারের পতন। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। তবে ব্যক্তি খাতে পতন হলেও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে মোট বিনিয়োগ কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে। অথচ নির্বাচনী বছরে সরকারি খাতের বিনিয়োগও নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চলতি বছরে মোট বিনিয়োগে হারের পতন ঘটতে পারে।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত্ম হবে। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দেখা দিবে। জিডিপি গ্রোথ কমে যাবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবমিলিয়ে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন ছিল তা দীর্ঘায়িত হবে।

উৎসঃ যায়যায়দিন