Wed. May 7th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮: কথা ছিল লেকের পাড় বাঁধাই হবে মাটি ফেলে, তার ওপর বালু ও ইটের খোয়া। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী ফেলা হয়নি মাটিই। বালু দেওয়ার বিষয়টিও একই রকম। খোয়াও ফেলা হয়েছে অল্পস্বল্প। ফলে খোয়ার ওপর দেওয়া কংক্রিটের ব্লকগুলো গেছে দেবে, ভেঙে গেছে কতকগুলো। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা আবাসিক শহর প্রকল্পের (তৃতীয় পর্ব) লেকের কাজ হয়েছে দৃশ্যত এ রকম, অতিশয় নিম্নমানের।

প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে অনেক অভিযোগ ওঠার পর উত্তরা তৃতীয় পর্বের ফাইলপত্র জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন চলছে তদন্তের কাজ। রাজউকের কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপ করছে দুদকে।

এ প্রসঙ্গে উত্তরা তৃতীয় পর্বের প্রকল্প পরিচালক ওমপ্রকাশ নন্দী বলেন, ‘দুই মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। যেসব কাজ নিয়ে দুদক তদন্ত করছে, সেসব আগের কাজ। লেক, ব্রিজ ও রাস্তার কাজের মান নিয়ে যাচাই-বাছাই করছে দুদক। মাঝে মাঝেই চিঠি দিয়ে বিভিন্ন ফাইলপত্র চাইছে তারা। রাজউক সেগুলো একে একে সরবরাহ করে যাচ্ছে।’

জানা গেছে, ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের উত্তরা আবাসিক শহর তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের মূল উন্নয়ন কাজ শুরু হয় বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমল থেকে। মাটি ভরাট, রাস্তা নির্মাণ, লেক খনন ও সেতু নির্মাণের কাজ হয়েছে প্রকল্প এলাকায়। বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার জানান, রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে মাটি ফেলা হয়। যে পরিমাণ মাটি ফেলার কথা ছিল, ঠিকাদার সেটা ফেলেননি। ফলে রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে পরবর্তী ঠিকাদার বিপাকে পড়েন। তখন ওইসব ঠিকাদার রাজউকে অভিযোগ দেন। রাজউক তখন রাস্তার কাজের জন্য উদ্ৃব্দত দরের চেয়ে আরও অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে রাস্তার কাজ শেষ করে। সেই রাস্তার কাজও হয়েছে নিম্নমানের।

একইভাবে প্রত্যেকটি লেকের ক্ষেত্রে প্রথমে পাড়ে মাটি ফেলা হয়েছে কম। এমনকি মাটির ওপর বালু দিয়ে যে পরিমাণ খোয়া দেওয়ার কথা ছিল, সেটাও দেওয়া হয়নি। একমাত্র যেসব পয়েন্টে বৃক্ষরোপণের কথা ছিল, সেই পয়েন্টে কিছু খোয়া দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরপি-উদয়ন বিল্ডার্স জেভি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পে একটি ব্রিজ নির্মাণের কাজ পেয়েছিল। পরে ওই ব্রিজের উপযোগিতা না থাকায় সেটা বাদ দেওয়া হয়। উদয়ন বিল্ডার্সকে বিনা দরপত্রে দ্বিগুণ বাজেটে ৭ নম্বর লেকের কাজ দেওয়া হয়। অথচ অতীতে কয়েকটি কাজ ঠিকমতো সম্পন্ন না করায় আরপি-উদয়ন জেভিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল রাজউক। অথচ সেই আরপি-উদয়ন জেভিকেই আবার রাজউক কাজ দেয়। এ ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তাদের মধ্যে রয়েছে নিয়াজ ট্রেডার্স, সালাম খান কনস্ট্রাকশন, পদ্মা কনস্ট্রাকশন, মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন, হায়দার কনস্ট্রাকশন, মেসার্স এমএইচ খান, রেজা এন্টারপ্রাইজসহ আরও কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ বরাদ্দ হলেও ওই প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে অন্যরা কাজ করেছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ এসেছে লেক ও রাস্তার কাজের ক্ষেত্রে।

রাস্তার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা রেজা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘তিনি একটা রাস্তার কাজ করেছিলেন। সেটি হলো বেড়িবাঁধ থেকে প্রকল্পে ঢোকার পর ব্রিজ পর্যন্ত অংশ। ওই রাস্তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল

করে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের সব মালপত্র লরিতে ওই রাস্তার ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ জন্য রাস্তাটি ভেঙে গেছে। কিন্তু যেসব সড়কে ভারী যানবাহন চলে না, সেগুলো ইতিমধ্যে তিন-চারবার মেরামত করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে আগে যারাই রাজউকের কাছে অভিযোগ করেছে, পরে দেখা গেছে রাজউক তাকেই গিল্টি বানিয়ে ফেলেছে। এ জন্য এখন আর কেউ অভিযোগ দেয় না। সুবিধাবাদীরা যার যার মতো করে কাজ করে।

উত্তরা আবাসিক (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গোলাম মোস্তফা, ফিরোজ আহমেদ, মো. নুরুল ইসলাম ও রাজউকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে থাকা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি কখনও উত্তরা তৃতীয় পর্বের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেননি। অনেক দিন আগে মো. নুরুল ইসলাম নামে একজন গণপূর্ত থেকে প্রেষণে রাজউকে যোগদান করেছিলেন। তিনিই প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া গোলাম মোস্তফা ও ফিরোজ আহমেদও বর্তমানে রাজউকে নেই।’

জানা গেছে, এসব ব্যক্তি দায়িত্বে থাকার সময়েই প্রকল্পের এসব কাজ হয়েছে। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিম্নমানের কাজ করেছেন ঠিকাদাররা। এ ক্ষেত্রে কাজ বরাদ্দ থেকে শুরু করে বিল নেওয়া পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে বিপুল অর্থের। ৩২টি রাস্তা, ৮টি ব্রিজ ও কয়েকটি লেকের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী এসব ফাইলের অনিয়ম তদন্ত করছেন। এ প্রসঙ্গে ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুদক যাতে কোনো ঝামেলা না করে এ জন্য রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তা দুদকের সঙ্গে দেনদরবার করছেন।’

এ প্রসঙ্গে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সমকালের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘দুদক কী করছে না করছে সে ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। চেয়ারম্যান সাহেবই ভালো বলতে পারবেন।’

এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘উত্তরা প্রকল্পের কিছু রাস্তার বিষয়ে দুদক তদন্ত করেছে। সেসব রাস্তার কাজের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। তাদের তো এখতিয়ার আছে এগুলো তদন্ত করে দেখার। এ জন্যই তারা দেখছে। যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি পায়, তারা দেখুক। এ ব্যাপারে রাজউকের কোনো আপত্তি নেই।’

সরেজমিন দেখা যায়, বেড়িবাঁধ ধরে প্রবেশের শুরু থেকেই প্রকল্পের রাস্তাটির বেহাল দশা। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প সংলগ্ন ব্রিজ থেকে উত্তর দিকে মেট্রোরেলের শুরুর পয়েন্ট পর্যন্ত চলে যাওয়া সড়কটির ভেঙেচুরে গেছে বিভিন্ন অংশ। এ ছাড়া খালপাড় থেকে মেট্রোরেল পর্যন্ত সড়কটির পুরোটাই ভাঙাচোরা। লেকের পাড়গুলোও একই। সড়ক বিভাজকগুলোর অবস্থা তছনছ। কংক্রিটের ব্লক কোথাও কোথাও খুলে নিচে চলে গেছে। তার নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে বালুমাটি। সমকাল