খােলা বাজার২৪। শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পাহারাদার। সার্বভৌমত্বের পাহারাদার। স্বাধীনতা রক্ষার সৈনিক। এসব দায়িত্ব তিনি ইচ্ছা করে নেননি। সময়ের প্রয়োজনে তাকে এ দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ১৯৮১ সাল থেকেই তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আজকে যারা রাজপথে লড়াই করছেন, তাদের শিশুবয়সেই খালেদা জিয়াকে রাজপথে দেখে আসছেন। তাই রাজপথের কোটি জনতার ‘মা‘ বেগম খালেদা জিয়া। এই ‘মা’কে অসম্মান করায় কেঁদেছেন অসংখ্য মানুষ। রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে অনেকে। যে পুলিশ বুট দিয়ে মায়ের সন্তানকে আঘাত করেছে, সেই পুলিশের হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা গুমরে কেঁদেছে।
সত্তরোর্ধ একজন নারীকে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অসম্মান করা হলো। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান। স্বাধীনতার ঘোষকের স্ত্রীকে অসম্মান করা হলো। এই অসম্মানের কারনেই কষ্ট পাচ্ছে অনেক মানুষ। কারাগারে খালেদা জিয়ার ভয় নেই। কারন তিনি কারাগার চিনেন। একাত্তরে যখন মুজিব পরিবার ৩২ নম্বরে কৈ মাছের ঝোল খেয়েছেন, তখনও এই বেগম খালেদা জিয়া দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বন্দী ছিলেন। প্রিয় মাতৃভুমিকে মুক্ত করতে জিয়াউর রহমান মাঠে লড়েছেন, খালেদা জিয়া বন্দী থেকেছেন। সেই ত্যাগের ফলে এবং অসংখ্য মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরে বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে বিপথগামী সেনাবাহিনীর দ্বারা জিম্মি অবস্থায় থেকেছেন। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরতে দেখেছেন স্বীয় স্বামী জিয়াউর রহমানের সাহসী পদেক্ষপের মাধ্যমে। স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে জিম্মি থেকেছেন, আত্মগোপনে গিয়েছেন, ফিরে এসে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছেন। সাহসী ও আপসহীন ভুমিকা রেখেছেন সবসময়। এক-এগারোর গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি আপসহীন থেকেছেন। এতে এক-এগারোর জগদ্দল পাথর সরতে বাধ্য হয়েছে। তবে তাদের ধারাবাহিকতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন করা হয়েছে।
তাবেদার শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে চলছেন বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্রকে ভুলিুন্ঠিত করতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থাকে ব্যানিটি ব্যাগে ভরে কবর দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বেগম খালেদা জিয়া ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়েছেন। সারাদেশে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন তিনি। সর্বত্র জনজোয়ার বেগম খালেদা জিয়ার ক্যারিশমা। এটা কোনো হিং¯্র লাঠিয়াল জনতা নয়, অহিংস সাধারণ মানুষের ¯্রােত সবখানেই বেগম জিয়ার সাথে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া সর্বত্র জনপ্রিয় খালেদা জিয়া। সব বয়সের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয়। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ের পথেই তিনি এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার এই জনপ্রিয়তায় শত্রুরা যার-পর-নাই ভীতসন্ত্রস্ত্র। সে হোক গদি দখলে রাখা গো-সাপ, কিংবা আধিপত্যবাদী শক্তি। চলমান লড়াইকে খালি চোখে আমরা ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন। এখানে মূলত:ই এখন প্রধান ইস্যু প্রিয় বাংলাদেশের ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র’। গণতন্ত্রকে দাফনের সব আয়োজন সম্পন্ন।
সার্বভৌমত্বকে নানা চুক্তির বরাতে ইতোমধ্যে কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে। প্রিয় মাতৃভুমির সার্বভৌমত্ব নিয়ে যারা কাজ করেছেন, কথা বলেছেন; তাদেরকে নানাভাবে নিঃশেষ করা হয়েছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে স্তব্ধ করতে যার-পর-নাই হয়রানি চলেছে। তখন আমরা এটাকে ইভেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েছি! সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আজীবন কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য বুদ্ধিজীবী যারা গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলতেন, তাদের কন্ঠরোধ করা হয়েছে। শফিক রেহমান এখন কথা বলতে পারছেন না। ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ, ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, আসাফউদ্দৌলাদের বর্তমান প্রজন্ম অনেকে চিনতেই পারে না। এটা কঠিন বাস্তবতা।
বাকী আছেন সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রধান সিপাহসালার দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া। আশপাশের সব গুরুত্বপূর্ণ সৈনিকদের নিরস্ত্র কিংবা হত্যা করার পর এবার প্রধান সিপাহসালারকে ঘায়েল করতে উদ্যত শত্রুপক্ষ। আর এজন্যই আজ ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ ‘কেয়ারার অব সুভরেইনটি‘ বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনি যেভাবে গণতন্ত্রের আইকন হয়ে উঠেছেন, তাতে এতোটুকু আশা করা যায়; বেগম খালেদা জিয়াকে নিঃশ্বেষ করা যাবে না। তিনি আপসহীন আছেন, থাকবেন। গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি আপসহীন থাকলে, আর বাংলাদেশের জণগণের মধ্যে এই চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে পারলে শত্রুপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য।
যারা কেবল ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে এতোদিন ব্যস্ত ছিলেন, কিংবা তৈলমর্দনের প্রতিযোগিতা ও সেলফি রাজনীতি চর্চায় রত আছেন; তাদের প্রতি অনুরোধ- প্লীজ বিদায় নিন। রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করুন, নইলে আপনাদের ছাড়াই বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ‘মা’ বেগম খালেদা জিয়ার পাশে আছে, থাকবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ‘আইকন অব ডেমোক্রেসি‘ বেগম খালেদা জিয়া লড়াই করবেন, এটা তাঁর প্রতিজ্ঞা। এটি কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই নয়, এটা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। এতে রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করা জরুরী। এই রাজনীতিতে সেলফিবাজির স্থান নেই। কারন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ আজ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পাহারাদার বেগম খালেদা জিয়ার জেলযাত্রায় চোখের অশ্রু ঝরাতে গিয়ে কোনো সেলফি তুলেননি। নিজেদের ভালাবাসাকে প্রকাশ করতে ফেসবুকেও গ্রুপ ফটো দেননি। আপনারা আপনাদের গ্রামের স্বজনদের কাছে জানতে পারেন, কিভাবে চোখের পানি ঝরেছে – নানা বয়সের মানুষের। কিভাবে তারা ‘জনগণের খালেদা জিয়া’র জন্য ভালবাসা প্রকাশ করেছেন।
কেমন ছিল আজকের জেলযাত্রা: ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বেগম খালেদা জিয়ার জেলযাত্রা ঐতিহাসিক। পৃথিবীতে এমন কোনো জেলযাত্রার ইতিহাস রচিত হয়েছে কি-না সন্দেহ। সরকার তাকে কারাগারে পাঠাবে বলেই ১৪৪ ধারা জারি করেছিল রাজধানী ঢাকায়। মানুষ ১৪৪ ধারা মানেনি। হাজার হাজার মানুষের মিছিল আর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে খালেদা জিয়া আদালতে পৌঁছেন। সেখানে মাত্র ১৫ মিনিটে সরকারের লিখে দেয়া রায় পড়ে শোনান জাজ। আর পেছনের দরজা দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পাহারাদার বেগম খালেদা জিয়াকে পুরোনো ঢাকার কারাগারে নেয়া হয়। ‘কেয়ারার অব সুভরেইনিটি‘কে কারাগারের ডে কেয়ার সেন্টারে থাকতে দেয়া হয়েছে। যতদূর আইনজীবীদের মাধ্যমে জেনেছি, বেগম খালেদা জিয়া মানসিকভাবে শক্ত আছেন। কিছুটা আফসোসের কথা জানালেও তিনি সবাইকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করতে কৌশলী হতে বলেছেন।
কি হবে পরবর্তী পদক্ষেপ?: আইনী মোকাবেলা অনুযায়ী আগামী সপ্তাহে বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আবেদন করবেন তাঁর আইনজীবীরা। হয়তো আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে জামিনের সুযোগ হতে পারে। তবে এটাও নির্ভর করে শত্রুপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর।
তাহলে জাতীয়তাবাদী শক্তির করণীয় কি?: ‘একদিনে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠা যায় না‘। আবার ‘চাইলেই বেগম খালেদা জিয়া হওয়া যায় না’। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। সারাদেশে অসংখ্য মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার পাশে আছে। এখন যারা বিএনপির নেতৃত্বে আছেন, তাদের দায়িত্ব হলো এই মানুষদেরকে সঠিক গাইডলাইন দেয়া। আন্দোলনের কর্মসূচি কি দেবেন, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো- কর্মসূচির ফলাফল কিভাবে ঘরে আনবেন, সেটির সিদ্ধান্ত নেয়া। নিশ্চয়ই দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দেবেন, কিন্তু প্রধান দায়িত্ব রাজপথের নেতাদের। যারা সামনে থেকে রাজপথ দেখছেন; তাদের চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। পারবে না। তাই মাঠের নেতাদের আরো কৌশলী এবং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের জেল এবং জনাব তারেক রহমানকে দশ বছরের জেল দেয়ার ঘটনা স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়নি। এটা দীর্ঘ পরিকল্পনার পদক্ষেপ। দেশবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী একটি ষড়যন্ত্র। অতএব, পাল্টা পরিকল্পনাটাও হতে হবে সমৃদ্ধ ও কৌশলী। আর তা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ ও সাহসিকতার বিকল্প নেই।
লেখক: এম মাহাবুবুর রহমান, সাংবাদিক, লন্ডন।