Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮:  পুলিশ বাহিনীতে কোনো পদে নিয়োগ পেতে হলে সংশিস্নষ্ট জেলার এসপি, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাকে ৫-৭ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে জনশ্রম্নতি রয়েছে। তা না হলে সর্বোচ্চ যোগ্যতা থাকলেও চাকরি নামের সোনার হরিণ অধরাই রয়ে যাবে। বছরের পর বছর ধরে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই অপতৎপরতা অলিখিত নিয়মে পরিণত হলেও এবার সে কলঙ্ক মুছতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষ। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, যোগ্য প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত করতে পরীক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি প্রার্থী নির্বাচক প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নয়া এই কৌশলে পুলিশ নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির দুর্নাম সহজেই ঠেকানো যাবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। এ ছাড়াও প্রার্থীদের চাকরি পেতে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে না হওয়ায় তারা তাদের কর্মজীবনেও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবেন- এমনটাই আশা করছে শীর্ষ পুলিশ প্রশাসন।

পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল নিয়োগে সংশিস্নষ্ট জেলার এসপি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই সুযোগে তাদের অনেকেই নিয়োগ-বাণিজ্য চালিয়েছেন। পাশাপাশি স্থানীয় সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা তার কাছে সহজেই তাদের তদবিরের দীর্ঘ তালিকা ধরিয়ে দেন। মন্ত্রীরাও ডিমান্ড অর্ডার বা ডিও লেটার দিয়ে তদবির করেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও তাদের পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি দেয়ার জন্য এসপিকে চাপে রাখার বিষয়টি রীতিমতো রীতিতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীতে যাতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ অনুষ্ঠিত হয়, এ জন্য নয়া পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এখন থেকে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দুইজন অ্যাডিশনাল এসপিকে নিয়োগ কমিটির সদস্য করে সংশিস্নষ্ট জেলায় পাঠানো হবে। তবে তিনি কোন জেলায় যাবেন, তা নিয়োগ পরীক্ষার একদিন আগেও তাদের তা অজানা থাকবে। নির্ধারিত দিন সকালেই তাদের এ বিষয়টি জানানো হবে। এভাবে হুট করে পুলিশের দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নিয়োগ পরীক্ষার নির্বাচক করে পাঠালে দুর্নীতি করার সুযোগ বন্ধ হবে। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা রাজনৈতিক নেতা তাকে আগে থেকে চিনতে পারবে না। এতে তাদের নিজেদের প্রার্থী নিয়োগের জন্য তদবির করার সুযোগ কম থাকবে।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো দুইজন অ্যাডিশনাল এসপি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের গাফিলতি, দুর্নীতি কিংবা কোনো অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিক হস্ত্মক্ষেপ করতে পারবেন অথবা এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত প্রতিবেদন জমা দিবেন। যা পর্যালোচনা করে পুলিশের শীর্ষ প্রশাসন সংশিস্নষ্ট প্রার্থীর নিয়োগ বাতিল করবেন। এমনকি সংশিস্নষ্ট জেলার পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াও বাতিল করা হতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত সময় জেলা এসপির হাতে একক ক্ষমতা থাকায় ঘুষদাতা প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও তাকে অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে কৃতকার্য দেখানো হতো। নিয়োগ-বাণিজ্য সিন্ডিকেটের কারিশমায় মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নও সংশিস্নষ্ট প্রার্থী আগভাগেই জানতে পারত। এরপরও কেউ এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে না পারলেও তাকে যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও বিস্ত্মর অভিযোগ রয়েছে।
তবে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অবৈধ সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হবে বলে দাবি পুলিশের শীর্ষ প্রশাসনের। এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সংশিস্নষ্টরা জানান, এখন থেকে পুলিশ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে দুইজন অ্যাডিশনাল এসপিকে সংযুক্ত করা হবে, তারা যে কোনো প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার খাতা যাচাই করতে পারবেন। এতে কোনো ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেলে, তা পুনর্মূল্যায়নের ক্ষমতাও তাদের হাতে থাকবে।
অন্যদিকে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব জেলার কোটা বেশি নিজেকে সে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে দেখাতে একখ- জমির ভুয়া দলিলপত্র বানিয়ে প্রার্থীদের চাকরির আবেদন করার যে হিড়িক রয়েছে, তা ঠেকাতেও এবার কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এতে কেউ এ ধরনের প্রতারণা করলে তা সহজেই ধরা পড়বে। এমনকি এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরাও দ্রম্নত চিহ্নিত হবে বলে আশা করছেন সংশিস্নষ্টরা।
পুলিশের একজন সাবেক আইজি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আগের পুলিশিংয়ের চেয়ে বর্তমান পুলিশিংয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিটা বন্ধ করা যায়নি। যারা ৮-১০ লাখ টাকা দিয়ে পুলিশে চাকরি নিয়েছে, তারা জনগণকে সেবা দেয়ার চেয়ে অর্থ আয়ের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। নানা ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকৃত টাকা তোলার চেষ্টা করছে। তাই পুলিশের নিয়োগ-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করা গেলে তা বড় ধরনের সুফল বয়ে আনবে বলে মন্ত্মব্য করেন সাবেক ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে পুলিশের নিয়োগ-বাণিজ্য ঠেকাতে নতুন যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাদের ভাষ্য, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে যে দুইজন অ্যাডিশনাল এসপিকে নিয়োগ কমিটিতে সংযুক্ত করা হচ্ছে, তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার (এসপি) অনৈতিক কার্যক্রমে কতটা হস্ত্মক্ষেপ করতে পারবেন- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। এ ছাড়া হুট করে নতুন জেলায় শুধুমাত্র নিয়োগ প্রক্রিয়ার মূল্যায়নে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা (অ্যাডিশনাল এসপি) নিয়োগ-বাণিজ্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের গোমর কতটা খুঁজে পাবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
প্রসঙ্গত, ৯০ দশকের প্রথম দিকে জেলায় জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একজন করে এআইজিকে নিয়োগ কমিটির প্রধান করা হতো। ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাকে চিনত না। এ জন্য নিজেদের প্রার্থী নিয়োগের জন্য জোর তদবির করার সুযোগও পেত না। তবে সেই প্রক্রিয়ায় পরবর্তী সময় নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধ করা যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বরাবরের মতো এবারও পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদের নিয়োগ ঘিরে বিপুলসংখ্যক সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। যা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী অবগত হন। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ডিআইজি মাসুম রব্বানী কনস্টেবল নিয়োগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। এর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরম্নত্বসহকারে দেখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে নির্দেশ দেন। এর পরপরই ওই পদের নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
গত ২১ ডিসেম্বর এই পদে ১০ হাজার পুলিশ সদস্য নেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, যাদের মধ্যে আট হাজার ৫০০ পুরম্নষ এবং এক হাজার ৫০০ নারী সদস্য নিয়োগ দেয়ার কথা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৬ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। আর ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর লিখিত পরীক্ষা নেয়ার কথা ছিল ১৮-৩০ জানুয়ারির মধ্যে। লিখিত পরীক্ষার ফল ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার কথা ছিল ২৪-৩১ জানুয়ারির মধ্যে। আর মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার জন্য ২৪ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রম্নয়ারি সময় বেঁধে দেয়া হয়।