Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

 

খোলাবাজার২৪ঃ শুক্রবার ২৫মে, ২০১৮ঃ  তিন দিন ঢাকার তিনটি আন্ডারপাস ও ৮২টি ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়েছে বাংলাদেশ স্কাউটস। তাদের সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও ছিল। সেই কাজের গল্প, কেন দুর্ঘটনা ঘটে? দুর্ঘটনা রোধের উপায় এবং ফুট ওভারব্রিজগুলোর অবস্থা নিয়ে প্রধান ফিচার লিখেছেন বেনজীর আবরার

গত ২৮ এপ্রিল, ৫ ও ১২ মে—এই তিন দিন ‘পরিষ্কার শহর, পরিষ্কার বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশ স্কাউটস আয়োজন করল এক কার্যক্রম। স্কাউটসের সমাজ উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য বিভাগের এই আয়োজনে সঙ্গী হয়েছিল ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঢাকা মহানগরীর দুই পৌরসভার তৈরি তিনটি আন্ডারপাসসহ ৮২টি ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার ও সেগুলো পরিছন্ন রাখতে রাজধানীবাসীকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতেই কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হয়। তিন দিনের এই উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ স্কাউটসের ২৩৭তম জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা বসে। পরে কাকরাইলের স্কাউট ভবনে ১৭ এপ্রিল ৫৩ জন সিনিয়র স্কাউটারের অংশগ্রহণে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়। তাঁদের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি করে মোট আটটি ভেন্যুতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৩৫৩ জন ছেলে ও মেয়ে রোভার স্কাউটকে ঢাকার ফুট ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলো কী অবস্থায় আছে, সেসব জানানোর জন্য আলাদা আলোচনা ও প্রশিক্ষণসভার আয়োজন করা হয়। এরপর ১৮ এপ্রিল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত, ঘনবসতিপূর্ণ, প্রয়োজনীয় ও আর্থিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফার্মগেট ফুট ওভারব্রিজে সকাল ১০টায় উপস্থিত হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবীণ কাউন্সিলর মো. ওসমান গনি। কার্যক্রম উদ্বোধন করে প্যানেল মেয়র বলেন, ‘দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই শহরে দুই সিটি করপোরেশনের মোট পরিচ্ছন্নতাকর্মী পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি নয়। তাঁদের মাধ্যমে বিশাল এই শহর পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়। সে জন্য ঢাকা শহরের মানুষকে সচেতন, আন্তরিক হয়ে শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করতে হবে। কারণ এই শহরে তাঁরাই বাস করেন।’ সকাল ১১টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিএসএমএমইউর পাশে ফুট ওভারব্রিজে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঢাকা শহর পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। 

যেভাবে হলো কাজ 

প্রতিটি ওভারব্রিজের নিচে ২০ জন করে স্কাউট ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দুজন সুপারভাইজার ও সিটি করপোরেশনের সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী। স্কাউটরা লিফলেট বিলি করেছেন, বৃদ্ধদের ফুট ওভারব্রিজে উঠতে সাহায্য করেছেন, নিয়ম মেনে যাঁরা ওভারব্রিজ ব্যবহার করেছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, যাঁরা নিয়ম ভেঙেছেন তাঁদের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের উপকারিতা জানিয়েছেন। তিন দিনই তাঁরা সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলোতে কাজ করেছেন।      

পথের গল্প

ঢাকার মধ্য বাড্ডার ফুট ওভারব্রিজে লিফলেট বিতরণ করেছেন তৌহিদুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রোভার স্কাউট বললেন, ‘আমরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা না পেরিয়ে ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পথচারীদের অনুরোধ করেছি। মানুষকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করেছি, তাঁদের মধ্যে লিফলেট বিলি করেছি। ফলে অনেকেই রাজপথ ছেড়ে ফুট ওভারব্রিজে উঠেছেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউটের রোভারমেট রাবেয়া আক্তার বললেন, ‘আমার ফুট ওভারবিজ ও আন্ডারপাস আমি ব্যবহার করব ও পরিচ্ছন্ন রাখব—এই শিরোনামের লিফলেট নিয়ে ২৮ এপ্রিল প্রথম দিন নগরবাসীকে সচেতন করার কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের ফুট ওভারব্রিজগুলোতে কাজ করে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে চালকরা খুব বেশি দায়ী। পথচারীরা মোটেও সচেতন নন। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যথেষ্ট ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও সেগুলো খুব কমই ব্যবহার করা হয়। মানুষ ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হচ্ছে। ফুটপাতগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি, ওভারব্রিজগুলোও তা-ই। ফলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দোকানপাটের ময়লা রাস্তার পাশে ফেলে রাস্তা ব্যবহারের অযোগ্য করে রাখা হচ্ছে। অথচ পাশেই আছে ডাস্টবিন। তবে আমাদের এই উদ্যোগ ঢাকাবাসী ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিয়মিত এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে ঢাকাবাসী পথ চলাচলে আরো সচেতন হবে, দুর্ঘটনাও কমে যাবে। ঢাকা পরিচ্ছন্ন হবে, একে নিরাপদ নগরে রূপ দেওয়া যাবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন সিনিয়র রোভারমেট মো. আল মুমিন বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একজন পথচারী বলেছেন, এসব মাইকিং করে কী হবে, বিদেশে গিয়ে কাজ করো। আরেকজন বলেছেন, খামাখা রোদে ঘুরে লাভ কী? বাসায় গিয়ে বসে থাকো। তবে অনেকেই আমাদের কথা শুনেছেন, অনেকে মাথায় হাত দিয়ে দোয়াও করেছেন।’

স্কাউটদের পরামর্শ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের সিনিয়র রোভারমেট মো. আবু সুফিয়ান বললেন, ‘শাহবাগে তিনটি ফুট ওভারব্রিজ আছে। তবে সেগুলোতে বিএসএমএমইউর রোগীদের উঠতে খুব কষ্ট হয়। তাঁরা চলন্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছেন, যাতে বয়স্করাও সেগুলোতে চলাফেরা করতে পারেন। ফুট ওভারব্রিজগুলোতে ভিক্ষুক, নেশাগ্রস্ত ও পতিতারা বসে থাকে। তাদের এসব জায়গা থেকে না সরালে সাধারণ পথচারীরা ব্যবহার করতে পারবেন না। বেশ কিছু ফুট ওভারব্রিজ জায়গামতো না রেখে আরো সামনে বা পেছনে স্থাপন করা হয়েছে।’ 

খাবারদাবার

এক হাজার ৩৫৩ জন স্কাউটের বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রতিবারই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন খাবার পৌঁছে দিয়েছে। সকাল ৯টার মধ্যেই সকালের নাশতার খরচ প্রতিটি দলের সমন্বয়কের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। দুপুর ১টার মধ্যে পাঁচটি গাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে সিটি করপোরেশনগুলো। খাবারের মেন্যু ছিল শাহি পোলাও। কোনো ফুট ওভারব্রিজে খাবার সময়মতো পৌঁছতে না পারলে পরে পাঠাওয়ের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।           

যেভাবে সমন্বয় করা হয়েছে

বাংলাদেশ স্কাউটসের পরিচালক (সমাজ উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য) পরিচালক গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘স্কাউট ভবনে কার্যক্রমটি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়েছে। যে ফুট ওভারব্রিজে সমস্যা হয়েছে, তাত্ক্ষণিক সমাধান দিয়েছি। পুরো কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয়েছে, নিয়ম মেনে চলতে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করে নগরবাসীকে চলাচলে উত্সাহ দিয়েছি। ঢাকাবাসীও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। স্থানীয়রা আমাদের সদস্যদের শরবত ও খাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা জেনেছি, ঢাকার অনেক ফুট ওভারব্রিজ হকাররা দখল করে আছে, রাতে সেগুলোতে যথেষ্ট আলো থাকে না, ছিন্নমূল মানুষ বসবাস করে। এসব কারণে ফুট ওভারব্রিজগুলো অনেকে ব্যবহার করে না। এ সমস্যাগুলোর সমাধানে সিটি করপোরেশনগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।’  

কেন ঘটে দুর্ঘটনা? বাঁচার কী উপায়?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট দুর্ঘটনার ৪৯ শতাংশের শিকার হন পথচারীরা। শহরগুলোতে ঘটা দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই হয় ঢাকায়।’ এর কারণ কী? তিনি বলেন, ‘ঢাকার অতিরিক্ত জনসংখ্যা, রাস্তাঘাট পারাপারের নিয়ম সম্পর্কে পথচারীদের সচেতনতার অভাব, প্রয়োজনীয় স্থানে ফুট ওভারব্রিজ না করে আরো সামনে বা পেছনে তৈরি করা, পথচারীদের চলাচলের নির্দিষ্ট স্থান না থাকা আর থাকলেও সেগুলো নোংরা আবর্জনায় ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে থাকা ইত্যাদিই কারণ।’ তিনি ঢাকার পথে-ঘাটে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পরামর্শ দেন—‘আন্ডারপাসগুলোতে প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি উদাহরণ দেন, ‘নীলক্ষেত-চাঁদনিচক এলাকার তিনটি ফুট ওভারব্রিজের প্রথম ও শেষ ওভারব্রিজ মানুষ তেমন ব্যবহার করে না; কিন্তু মাঝেরটি বাধ্য হয়ে তাদের ব্যবহার করতে হয়। ফলে ওভারব্রিজগুলো কোথায় স্থাপন করতে হবে, তা সিটি করপোরেশনকে বুঝতে হবে। ফুট ওভারব্রিজগুলো প্রয়োজনে আরো ঠিকঠাক জায়গায় আবার স্থাপন করা হোক।’