Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

 

বাজেটে আছে নির্বাচনী ঘুষও

হোসেন জিল্লুর রহমান

 খােলা বাজার২৪।বৃহস্পতিবার ২৮ জুন ২০১৮ : অর্থমন্ত্রী এবার বাজেট করতে গিয়ে বড় কোনো ঝুঁকি নেননি। সেই অর্থে সংস্কারমূলক কোনো কাজ চোখে পড়েনি। যে সংস্কারে ঝুঁকি আছে, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নির্বাচনের বছরে মোটা দাগে কোনো পরিবর্তন এই বাজেটে লক্ষ করা যায়নি। অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন পক্ষকে খুশি করতে চেয়েছেন আসলে। কিন্তু এই খুশি করতে গিয়ে, ঝুঁকি না নিতে গিয়ে গভীরতর ঝুঁকিগুলো থেকে গেল। যেমন কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়ে বড় বা মোটা দাগে কোনো সংস্কার নেই। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে অপরিহার্য ছিল সংস্কার। সেই পথে যাওয়া হয়নি। একধরনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। কৌশলগত চিন্তার কোনো বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাইনি।

প্রস্তাবিত বাজেটকে জনতুষ্টিমূলক বলতে পারি। আর নির্বাচনের বছরে এটা কাম্যও বটে। জনতুষ্টির একটি উদাহরণ দিতে পারি। বাজেটে মাদ্রাসা ও স্কুলের সংস্কারে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটা মোট বাজেটের ৪ শতাংশ। এই বরাদ্দ মূলত এমপিদের জন্য। এটা একধরনের নির্বাচনী ঘুষ। এখানে তদারকির বিষয়টি এমপিদের হাতে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রকল্পে কী হয়, তা আমরা ভালো করে জানি।

আমরা যদি খাতওয়ারি আলোচনা করি, তবে আমাদের প্রধান বিচার্য বিষয় হলো মানসম্মত কর্মসংস্থান। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, বেশ খানিকটা সময় ধরে ভালো কথা বলেছেন। এগুলো আসলে ‘ভালোচনা’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আলোচনাকে তিনি কৌশলগত পর্যায়ের উন্নীত করতে পারেননি। এখানে উল্লম্ফনটা কীভাবে হবে, এর কোনো কথা নেই।

অর্থমন্ত্রী অস্বস্তির সঙ্গে একটি স্বীকারোক্তি করেছেন। গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তা হলো বাজেটের বড় আকার। এর ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও হলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই বাজেটে প্রায় ২০ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে। গত বছর ২১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি। গত বাজেটের অবাস্তবায়নের বিষয়টি তিনি একটু এড়িয়েই গেলেন। এই ধারাবাহিকতা যদি থাকে, তাহলে আমি হিসাব করে দেখেছি প্রস্তাবিত বাজেট আসলে ৩ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। বড় আকারের বাজেট করে তাই কতটা লাভ হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। আমার মনে হয়, এই অবাস্তবায়নের জন্য তিন ধরনের দক্ষতার সংকট রয়ে গেছে।

প্রথমটি, প্রকল্প প্রণয়নের দক্ষতার সংকট। অর্থাৎ অর্থায়নের কথা বিবেচনা না করেই প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আর সে কারণে সেগুলো অবাস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়টি, ব্যয়ের দক্ষতার সংকট। একটি কাজ ১০০ টাকায় করা যাবে। কিন্তু কাজটির পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে ১০০০ টাকা। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা এ সমস্যাটি বেশি করে দেখছি। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সর্বশেষ ১৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প করার বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু এ অর্থায়ন যদি অদক্ষতার সমার্থক হয়ে যায়, তখন এর কী মানে হতে পারে?

তৃতীয়টি, বাস্তবায়নের দক্ষতা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমছে। এর কারণ হলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ জন্য যে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি দরকার, তা নেই। হয়তো অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছা আছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিরও শুভ ইচ্ছা আছে। কিন্তু যে আমলাতন্ত্রকে দিয়ে এ কাজ করানো হবে, সেখানেই হয়তো দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে। 
বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতার সংকটের জন্য আবার আমাদের রাজনৈতিক শাসনও একটি কারণ। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতার মূল্যায়ন নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হচ্ছে। দক্ষ লোক সঠিক জায়গায় নেই।

আজ কর্মসংস্থানের বিষয় নিয়ে বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ একটি বড় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। কয়েক বছর ধরে এ সংখ্যা ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে তো আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। সরকারি বিনিয়োগে কর্মসংস্থান বাড়ানোর চিন্তাটা একেবারে আমলাতান্ত্রিক ভাবনা।

বিনিয়োগ বাড়াতে গেলে প্রবৃদ্ধির কৌশলের মোড় ফেরানো দরকার। আমি ১০ টাকার কাজ ১০০ টাকায় করে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি। তাতে আমার হিসাবের খাতায় বিনিয়োগ বাড়ল। কিন্তু এতে করে লাভটা কী হলো। বড় শ্রমবাজার এর লাভ কী পেল?

বাজেটে একটি নতুন দিক যুক্ত হয়েছে, ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম। এটা উদ্যোগ হিসেবে বেশ ভালো। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে ৮৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাত। এই আমলাতন্ত্রকে দিয়ে এই বিশাল খাতের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা এবং তা বাস্তবায়ন অলীক কল্পনামাত্র। তাই ধারণা হিসেবে ভালো হলেও এটিও ‘ভালোচনা’ হিসেবেই থেকে যাবে।

বাজেটে কৃষিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকি বাড়ানো বা কৃষি যন্ত্রাংশের ওপর থেকে শুল্ক কমানোর বিষয়গুলো বেশ ইতিবাচক। কৃষি উৎপাদন মাথায় রেখেই করা হয়েছে। কৃষির একটি বড় সংকট হলো এর বিপণন। কৃষিকে প্রবৃদ্ধির চালকে উপনীত করতে হলে উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন এবং ভ্যালুচেন তৈরিতে হাত দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয় নিয়ে বাজেটে কিছু চোখে পড়েনি।

হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান পিপিআরসি