Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খোলাবাজার২৪ সোমবার ১৬ জুলাই, ২০১৮ঃ  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের জাতির জন্য ‘সংস্কৃতি’ ব্যাপারটিকে আমি কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে উপলব্ধি করি। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শের জায়গায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ব্যাপারটিকে যাঁরা পছন্দ করতেন না তাঁরা তখন ‘ইসলাম’ নিয়ে সক্রিয় হন। আমি লক্ষ করলাম, নানা রকমভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা বেড়ে চলেছে এবং ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি জারি হওয়ার পরই মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী সক্রিয় হয়। মুসলিম লীগ নেতা খান আবদুস সবুর খান ১৯৭১ সালের ১৬  ডিসেম্বরের পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ হয়ে বিচারাধীন ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমায় হাজার পঞ্চাশেক আসামির সঙ্গে তিনিও কারাগার থেকে মুক্ত হন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয় নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একাধিক আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকাকালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং জাতীয় সংসদের অঙ্গনেই তাঁর কবর হয়। রেডিওতে, টেলিভিশনে তখন কলাবরেটর হিসেবে অভিযুক্ত ও সাধারণ ক্ষমায় ‘মুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা’ নিয়মিত দ্বিজাতিতত্ত্ব, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আস্তিকতা-নাস্তিকতা ও মুসলিম বাংলা ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। গোটা জাতির কাছে কলাবরেটররূপে বিশেষভাবে পরিচিত মাওলানা মান্নানকে জিয়া সরকার ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করেন। মাওলানা মান্নান তখন ইনকিলাব পত্রিকা ও কওমি মাদরাসার ধারাকে দ্রুত বিকশিত করেন। সাম্রাজ্যবাদী মহলের কোনো কোনো অর্থ সংস্থা তখন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের ইসলাম বিষয়ে গবেষণা করার ও সেমিনার করার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকে এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের প্রধান অংশ তখন এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনি আরো অনেক ঘটনা আছে।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ঘোষণা করে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। জনসাধারণ বাকশালকে ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। এর আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জনগণের বিরাগভাজন হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর, সপরিবারে ফজলুল হক মণির, সপরিবারে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের প্রাণহানির পর বাকশালের (আওয়ামী লীগের) নেতারা চরম দুর্গতির মধ্যে পড়েন। আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল মোশতাকের সরকার, কিন্তু মোশতাক সরকার টেকেনি। জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগের দুর্গতি কমেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও বুদ্ধিজীবী ভারতে, যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায় গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শওকত ওসমান সাত বছর ভারতে ছিলেন, কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম ১৩ বছর ভারতে ছিলেন। মওলানা ভাসানী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান নিয়ে থাকেন এবং জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে তাঁর সহায়তা গ্রহণ করেন। ভাসানীপন্থীদের একাংশ তখন ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারে তৎপর হয়। আর ভাসানী নিজে ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলে ইসলামের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। জাসদ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আত্মঘাতী লাইনে চলে যায় এবং আত্মদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে যায়। পরে জাসদ ভাঙতে থাকে। পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগবিরোধী, জাসদবিরোধী অবস্থান নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারে তৎপর থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এসবের প্রতিক্রিয়ায় ইসলামপন্থী অরাজনৈতিক শক্তি ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি বাড়তে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে ইসলামপন্থী সব ধারাই নাস্তিকতা বলে প্রচার করতে থাকে।

এ সময়ে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ ইসলাম ও নারী নিয়ে যেসব লেখা লেখেন সেগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থীরা—বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী তাতে অনেক অনেক তৎপর হয়েছে। পরে শওকত ওসমান দেশে এসে ‘শেখের সম্বরা’ ও আরো নানা লেখা দ্বারা একই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেন। প্রশ্ন হলো এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা লাভবান হয়েছেন, না ইসলামপন্থীরা?

বাংলাদেশে ১৯৮০-র দশকে দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করে এনজিও ও সিএসও  (civil society organizations)| এসবের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এসব আন্দোলনের মধ্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র মার খেয়ে যায়, গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয় নির্বাচনতন্ত্রে। জাতিকে বিভক্ত করে ফেলা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি’তে। আমি যতটা জানি ও উপলব্ধি করি, তাতে মনে করি বঙ্গবন্ধু এ ধরনের বিভক্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন। অপরাধীদের শাস্তি তিনি চেয়েছেন, সেই সঙ্গে ক্ষমার মনোভাবও তাঁর ছিল, সবাই মিলে দেশ গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেই তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তার পরের ঘটনাবলির কথা ক্ষমতাসীন মহল থেকে যেভাবেই প্রচার করা হোক না কেন, প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যাবলি জানেন এমন লোকের সংখ্যা দেশে কম নেই। বাস্তবতা এই যে বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো কার্যকর রাজনৈতিক দল নেই। আওয়ামী লীগও পরিণত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দলে’। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাসদ প্রভৃতি দল কর্মতৎপর আছে বটে, তবে জাতীয় জীবনে, জনজীবনে তাদের কর্মতৎপরতা কার্যকর হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ যা করতে চায় তা করতে পারে। তবে অন্যান্য দল তো বটেই, আওয়ামী লীগও ভেতর দিয়ে নিঃরাজনীতিকৃত হয়ে আছে। দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চিন্তা নেই, সমাজতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা বাকসর্বস্ব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী মাত্র। জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ নেই। যে আদর্শগত শূন্যতা দেশে বিরাজ করছে তার মধ্যে সামাজিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী শক্তি জাগছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা বুঝে ইসলামী শক্তির দিকে ঝুঁকছেন। ইসলামের দিকেও কি তিনি ঝুঁকছেন? সম্প্রীতির বাংলাদেশ নামে যে সংগঠন সরকারি বুদ্ধিজীবীরা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা কি ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা নিয়ে কাজ করবেন? জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে, সরকারের পক্ষে বুদ্ধিজীবীদের ওপর ভরসা করে চলা কিছুটা মুশকিল। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা যায়। বাকশাল গঠনের পর তখনকার সরকারি বুদ্ধিজীবীরা দলে-দঙ্গলে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, দলবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাকশাল গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করেছিলেন। বাকশালের পক্ষে তাঁরা কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন। যে বুদ্ধিজীবীরা সেদিন বাকশালের সদস্য হতে চাননি, তাঁদের ওপর বাকশালপন্থী সরকারি বুদ্ধিজীবীরা সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, ভয় দেখিয়েছিলেন এবং জুলুম-জবরদস্তি চালিয়েছিলেন। বাকশালে যোগ না দিয়ে থাকতে পেরেছিলেন এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা তখন নিতান্ত নগণ্য ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, ফজলুল হক মণি, সেরনিয়াবাত যখন সপরিবারে প্রাণ হারালেন, তখন সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন! …আওয়ামী লীগ বাকশালে গিয়ে শূন্যতায় পড়ে গেল।

এখন জাতির, জনজীবনের অবস্থা কি যথেষ্ট ভালো? এ প্রশ্নের নানা উত্তর আসবে। আমি বলব, আত্মসমালোচনা এখন পরনিন্দার চেয়ে বেশি দরকার। দেশের অবস্থাকে ভালো করতে হবে। যাঁরা আত্মপ্রসাদ নিয়ে পরনিন্দায় মত্ত আছেন তাঁদের মধ্যে আত্মশুদ্ধির মনোভাব, আত্মোৎকর্ষের চেষ্টা দেখা দিলে ভালো হবে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথেষ্ট নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে দরকার মুক্তিযুদ্ধের ও পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে ভক্তি, তাতে অন্ধত্ব কল্যাণকর নয়; অন্ধত্বের সঙ্গে ভণ্ডত্বও থাকে! মূল্যবোধ ও বিচার-বিবেচনা কল্যাণকর হবে।

আদর্শগত প্রশ্নে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কিছু পর থেকে চলে আসছে তাতে রাজনৈতিক মহলে এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সংস্কৃতিমনস্কতার প্রয়োজন আমি খুব অনুভব করেছি। সংস্কৃতি নিয়ে কিছু লেখা আমার আছে। যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভ্রান্তির মধ্যে বাংলাদেশ পড়েছে, তা নিয়ে আমার চিন্তা—‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’, ‘নৈতিক চেতনা ধর্ম ও আদর্শ, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ’, ‘জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও ভবিষ্যৎ’, ‘বাংলাদেশ কোন পথে’ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। সংক্ষেপে কাজের কথা বুঝিয়ে বলা যায় না।

আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারি বুদ্ধিজীবীরা জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় সংস্কৃতির কথা বলছেন। তবে তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর ওপর। বর্তমান আদর্শগত শূন্যতার মধ্যে সংস্কৃতি নিয়ে সরকারি মহলের চিন্তা খুবই অপর্যাপ্ত। এখানে সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুটা উল্লেখ করতে চাই।

‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ কথাটা ঠিক নয়, কথাটা হওয়া উচিত ‘বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ…।’ তিনি অমানুষদের প্রতি বিশ্বাস রাখতে বলেননি। অমানুষদের প্রতি বিশ্বাস তাঁর ছিল না। এসব প্রশ্নে আমাদের যথাযথ ধারণা অর্জনের চেষ্টা দরকার। বানরসদৃশ এক প্রাণী  (ape) জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে করতে মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং সেই মানুষ আপন সংস্কৃতিচেতনার বলে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করে চলছে। মানুষ পরিবেশকে পরিবর্তন করতে করতে নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া চলমান আছে। গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই  Man Makes Himself. এতে মানুষকে তিনি দেখেছেন সংস্কৃতিমান বিকাশশীল প্রাণীরূপে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজেদের গড়ে তোলা, সৃষ্টি করা, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে বিকশিত হয়ে চলা, সেই সঙ্গে পরিবেশকেও বিকশিত করে চলা—এরই মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির সংস্কৃতি।

The Descent of Manগ্রন্থে ডারউইন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কী করে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের জীবনযাত্রার, কাজের ও পছন্দ-অপছন্দের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করে চলছে। এরই মধ্যে উন্নতির সজ্ঞান সচেতন প্রয়াসও থাকে—থাকে সাধনা ও সংগ্রামও। মনোগত উন্নতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি, দুয়ের মধ্যেই মানুষের সক্রিয় ভূমিকায় নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিবেচনায় struggle for existence, natural selection ও  survival of the fittest প্রভৃতি ধারণাও বিবেচ্য। মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে ও উন্নতি করতে হয় একদিকে প্রকৃতির প্রতিকূল ও অনুকূল নানা শক্তির সঙ্গে জটিল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এবং অপরদিকে সমাজের অভ্যন্তরে জটিল সব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। মানুষের শক্তি হলো তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি। শুধু শারীরিক শক্তিই শক্তি নয়, মানসিক শক্তিও শক্তি এবং মানসিক শক্তিও শারীরিক শক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক শক্তি শরীর নিরপেক্ষ বা শরীরের বাইরের কিছু নয়। মনকে কখনো শরীর থেকে আলাদা করা যায় না। পরিবেশ থেকেও মানুষকে আলাদা করা যায় না।

ডারউইনের অনুসরণে স্পেন্সার  Evolution and Ethics গ্রন্থে মানুষের নৈতিক আচরণের ও নৈতিক চেতনার ক্রমবিকাশের বিবরণ রচনা করেছেন। ইতিহাসের ধারায় পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নীতিতে আছে অভিযোজন—গ্রহণ-বর্জন  (adaptation)| পরিবেশের স্পর্শে কিংবা প্রভাব থেকে মুক্ত কোনো চেতনার কিংবা মনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। মানসিক শক্তিও দেহেরই শক্তি। মানসিক শক্তির মধ্য থাকে নৈতিক শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির শক্তি—আদর্শ উদ্ভাবন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার শক্তি।

নৈতিক উন্নতির জন্য জ্ঞানগত ও চিন্তাগত উন্নতির সঙ্গে পরিবেশের উন্নতি সাধনও অপরিহার্য। মানুষ সেই জৈবিক সামর্থ্যের অধিকারী, যার বলে সে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারা নিজের ও নিজেদের সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। মানুষের বিবর্তনে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ সংস্কৃতিচেতনাই কর্তা। মানুষ তার পরিবেশকেও ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করে উন্নত করতে চায়। সংস্কৃতির মর্মে প্রগতির তাড়না ক্রিয়াশীল থাকে।

ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যরূপে বিরাজ করে অপসংস্কৃতি এবং দুয়ের মধ্যে চলে বিরোধ। অপসংস্কৃতিতে থাকে হীন স্বার্থপরতা, প্রগতির বিরোধিতা, অদূরদর্শিতা, স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার, ভোগবাদ, প্রতারণা, মনুষ্যত্বহীনতা। সংস্কৃতি বিকশিত হয় অপসংস্কৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে, অপসংস্কৃতিকে পরাজিত করে। জাতির জীবনে কখনো কখনো অপসংস্কৃতি কর্তৃত্বশীল থাকে।

বাংলাদেশের আমাদের অপসংস্কৃতির কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সংস্কৃতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য সাধনা ও সংগ্রাম—দুই-ই লাগবে। সাধনা দ্বারা বুঝতে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে; আর সংগ্রাম দ্বারা নিজেকে, নিজেদেরকে এবং নিজের ও নিজেদের পরিবেশকে পরিবর্তন করে উন্নত করতে হবে।

 

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়