খোলাবাজার২৪ রবিবার ২২ জুলাই, ২০১৮ : ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর তুলনায় একুশ শতকের পৃথিবী অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। মনে হতে পারে, দুই শতক আগের পৃথিবী বোধ হয় বেশ নিশ্চিন্ত, নির্ভার ও নিরুপদ্রব ছিল। তা যে ছিল না, তার প্রমাণ মেলে আফগানিস্তানের বাড়ি নির্মাণের স্থাপত্যকৌশল দেখে। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, কাবুলের বসতবাড়ি লুট করা সফল ব্যাপার নয়। প্রতিটি বাড়ি দুর্গের মতো করে বানানো—চারদিকে উঁচু পাঁচিল, সে-ও আবার খানিকটা উঠে ভেতরের দিকে বেঁকে গেছে—তাতে সুবিধা এই যে মই লাগিয়ে ভেতরে লাফিয়ে পড়ার উপায় নেই। দেয়ালের গায়ে আবার এক সারি ছেঁদা; বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে সে ছেঁদা দিয়ে রাইফেল গলিয়ে নির্বিঘ্নে বাইরে গুলি চালানো যায়। বাড়িতে ঢোকার জন্য মাত্র একখানা বড় দরজা—সে দরজা আবার শক্ত ঝুনো কাঠের তৈরি—তার গায়ে আবার ফালি ফালি লোহার পাত পেরেক দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। মোক্ষম বন্দোবস্ত। দু’খানা রাইফেল দিয়ে পঞ্চাশজন ডাকাতকে অনায়াসে ঠেকিয়ে রাখা যায়। তখনকার পৃথিবী নিরাপদ হলে এভাবে বাড়ি নির্মাণের প্রশ্ন আসত না।
দুই শতাব্দী আগের কথা ছেড়ে দিই। তিন হাজার বছর আগেও যে পৃথিবীর মানুষ নিশ্চিন্ত, নির্ভার ও নিরুপদ্রব জীবন কাটায়নি, তার প্রমাণ আছে। একটু নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে, বিপদ এড়াতে এবং নিরাপত্তার আশায় তিন হাজার বছর আগে চীন আবিষ্কার করেছিল ফেংশুই (মতান্তরে ফাংশুয়ে বা ফিংশুয়ে)। ফেংশুয়ের মতো পরাবিজ্ঞানপদ্ধতিতে সুখ-স্বস্তি-শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আবিষ্কার-পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে তা নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। মীমাংসায় পৌঁছানো যায়নি আজও। তবে পরাবিজ্ঞান এই ফেংশুয়েতে বিশ্বাসী একুশ শতকের মানুষ, যাঁরা ব্যবসায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে চান, তাঁরা ৯টি অ্যারোওয়ানা (ড্রাগন ফিশ) সাজিয়ে রাখেন। যাঁরা দীর্ঘ সুস্থ জীবন, সফল সন্তান প্রত্যাশা করেন, তাঁরা তিনটি ড্রাগন হর্স ঘরে রাখেন। যাঁরা অর্থ-সম্পদ আকাঙ্ক্ষী তাঁরা রাখেন সেইলিং শিপ। প্রেমপ্রত্যাশীরা ম্যান্ডারিন ফর লাভ। সৌন্দর্যপ্রত্যাশীরা ম্যাজিক মিরর। আনন্দপ্রত্যাশীরা লাফিং বুদ্ধ। জ্ঞানপ্রত্যাশীরা ক্রিস্টাল গ্লোব। স্বাস্থ্যপ্রত্যাশীরা মেটাল উইল্ডচাইম। কিন্তু একুশ শতকের দর্শন হলো—‘লায়ন শেয়ারিংয়ের’ দর্শন। ‘লায়ন শেয়ারিংয়ের’ আধিপত্যবাদী দর্শনের এই জটিল শতককে সরল ফেংশুয়ে দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে কি না সে এক প্রশ্ন। তবে তার আগে লায়ন শেয়ারিং নিয়ে দুই ছত্র বলা যাক। সিংহরাজ বনের অন্যান্য জন্তুর সঙ্গে শিকারে যেতে রাজি হলে শিকারের যে ভাগ সিংহ চায়, সেটি লায়ন শেয়ারিং। এক ভাগ সবার সঙ্গে শিকারে যাওয়ার জন্য। এক ভাগ সিংহী আর বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য। এক ভাগ সিংহের সাহসের জন্য। চৌঠা ভাগ শক্তি-বলে অন্য জন্তুদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ভাগ।
একুশ শতককে যদি এতটা ‘মাৎস্যন্যায়’ না-ও ভাবি, তবু এটা যে কো-অর্ডিনেশনের শতক, তা অন্তত মানতে হবে। অনেকটা দড়ির ওপর হাতে লাঠি নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর মতো। কেউ যখন হাতে লাঠি নিয়ে দড়ির ওপর হেঁটে যান, তখন তাঁকে খেয়াল রাখতে হয়, লাঠিটা যেন হাত থেকে ফসকে না যায়। নিজে যেন পড়ে না যান এবং যাঁরা খেলা দেখছেন, তাঁদের গায়ে যেন কোনোভাবে লাঠির আঘাত না লাগে। কো-অর্ডিনেশন বোঝাতে এই উদাহরণটি দেওয়া হলো। একুশ শতকের নির্বিরোধী কেরানি থেকে শুরু করে তুমুল ব্যস্ত প্রফেশনাল—প্রত্যেককেই বুঝতে হয় কো-অর্ডিনেশন। প্রত্যেক মানুষ আজ মাল্টিটাস্কার। ছুটছেন উসাইন বোল্টের গতিতে। কিন্তু অক্লান্ত গতির এত দৌড়ের পরও সুখের আয়ু হয়েছে কয়েক মুহূর্ত আর স্বস্তির আয়ু কর্পূরের সমান। একুশ শতকের নাগরিকদের অনিবার্য সঙ্গী মানসিক চাপ। তিন বছরের প্লে স্কুলের শিশুও যা থেকে মুক্ত নয়, আমরা কেউ কেউ ভাবি, শিশুরা খুব নির্ভার-নিশ্চিন্ত ও চাপমুক্ত জীবন কাটায়। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। শিশুদেরও মানসিক চাপ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বড়দের চেয়েও বেশি। প্রায় সব বয়সী বাচ্চাদের কমন মানসিক চাপ পরীক্ষায় ভালো ফল করার। মা-বাবার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পরীক্ষার ফলাফল না হলে পারিবারিক অশান্তিতে বাচ্চাদের মানসিক চাপ তৈরি হয়। পরিবারের কারো অসুস্থতা বা মাদকাসক্তি, আর্থিক সমস্যা, মা-বাবার দ্বন্দ্ব এবং যৌন নিগ্রহের কারণে শিশুরা মুখোমুখি হয় তীব্র মানসিক চাপের। বাড়ির সরল কিশোর-কিশোরীরও আছে চাপ। পড়াশোনার লড়াইয়ে সেরা হওয়া। সারাক্ষণ ফেসবুকে হুকড থাকার কারণে বাড়তি চ্যালেঞ্জ বেস্ট টিউবার হওয়ার।
দুই
ঠিক শত বছর আগে ‘মুক্তি’ কবিতায় লেখা হয়েছিল ‘রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা, বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা।’ ‘যেতে নাহি দিব’তে লেখা ‘সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান, ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দু-চারি খান/গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল, দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল/আমসত্ত্ব আমচুর সের দুই দুধ/এই সব শিশি কৌটা ওষুধ বিষুধ/মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভেতর।’ আজকের হেঁশেল ঠেলা গৃহিণী এই কবিতার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। কারণ এই সরল চক্র আর কোনোভাবে কার্যকর নয় তার জীবনে। ভেজাল খাবার আর ক্যালরি-জিরো ক্যালরির সমীকরণ মেলাতে প্রতি মুহূর্তে নাকাল হতে হয় তাকে। মাথা কুটে মরলেও একটি খাঁটি খাদ্যতালিকা তার পরিবারকে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হয় পরিবারের পুষ্টির কথা। আট থেকে আশি, পরিবারের সবাই যেখানে স্ক্রিনেজার (ইন্টারনেটে আসক্ত) এবং ইন্টারনেটের কল্যাণে সবাই যখন সবজান্তা, তখন সবাইকে খুশি রাখা এক কঠিন চাপ বটে। প্রতিবেশী দেশের ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ বা নিজ দেশের ‘অনন্যা’ জাতীয় গেম শো তাকে গৃহিণী নাম্বার ওয়ান হওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্দরমহলের অন্তরের খবর আমরা রাখি না, তাই জানি না নিরেট গৃহিণীকেও ভাবতে হয় পরিবারের আট থেকে আশি বছরের সদস্যরা কোন খাবারে অ্যাপেটাইট হন। আবার খেয়াল রাখতে হয়, অ্যাপেটাইজার যেন ফুড ভ্যালুর অনুপাত ক্যালরির চেয়ে কম হয়। খেয়াল করতে হয়, তাতে যেন রিফাইন্ড কার্ব আর ট্রান্সফ্যাট না থাকে। ফুড প্রেজেন্টেশনেও ফুল মার্কস পেতে হবে। ভাবতে হয়, পরিবারের কেউ যেন নিজেকে অতি বিশেষ বা লেফট আউট মনে না করে। তারও চ্যালেঞ্জ আছে বাড়ির অতিথির কাছে হোস্ট হওয়ার। অথচ নেই আব্দুর রহমানের মতো গৃহ-সহকারী। যার জুতা পলিশও আর্ট অব প্রেজেন্টেশন।
তিন
নিশ্চিন্ত জীবন কী? নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে নিশ্চিন্ত জীবনের ধারণা এমন এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, যেখানে ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি গিটার, পিয়ানো, পারকাসন, সাঁতার—সব শেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতই কি এতে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত হয়? এই ছন্দেই কি জীবনের মুক্তি? এই রুটিনে কি তাদের জানা হয় এই বসুন্ধরা কী অর্থে ভরা? আমাদের সন্তানরা জানে না কেন মেধা পাটকর পরিবেশ আন্দোলনে বিদ্রোহিনী হন। জানে না, কেন জাটিঙ্গা পাহাড়ে হাজার হাজার পাখি একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। জানে না, নির্জন পথে যেতে যেতে স্রেফ মোৎজার্টের সিম্ফনি বা বাউলগান শোনার আনন্দ।
চার
একবার সক্রেটিসকে তাঁর শিষ্যদল শহরের সবচেয়ে সেরা দোকান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। দুনিয়ার সব দামি দামি বিলাস সম্ভার সেখানে। মিসর ও ব্যাবিলনের নিদর্শন, প্যাপিরাসের বান্ডিল, অ্যালকেমির সরঞ্জাম। সক্রেটিসের চোখের পলক পড়ে না। এটা দেখছেন, সেটা নাড়ছেন। চোখের সাইজ ছানাবড়া থেকে সসারের আকার ধারণ করেছে। শিষ্যরা মহাখুশি—গুরু যে এত কৃছ্র সাধন আর ত্যাগের উপদেশ কপচান, সে শুধু সত্যিকার কোনো ভালো জিনিস দেখেননি বলে। স্বয়ং শিষ্য প্লেটো বিব্রত। একসময় সক্রেটিসের নিবিড় দেখাশোনা শেষ হলো। এবার সক্রেটিস করুণ কণ্ঠে বললেন—হায় হায়! দুনিয়ায় কত চিত্র-বিচিত্র জিনিস! কিন্তু এর একটি জিনিসেরও আমার প্রয়োজন নেই।
আমরা সন্তানদের সক্রেটিস হতে শেখাই না। শেখাই না ‘সবার দুঃখ দূর না হলে পরে/আনন্দ তার আপনারই ভার বইবে কেমন করে?’