খোলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮।। পাকিস্তানের স্বল্পদৈর্ঘ্যের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এবারের নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে উত্তেজনাকর এবং শঙ্কাপূর্ণ। যথাসময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ বিরাজ করছে। বোধ হয় তুরস্ক ও মিসরকে আদর্শ মেনে পাকিস্তানের রাজনীতির অভিভাবকরাও ভোটের আগে গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরেছে এবং নাগরিক সমাজকে ভয় দেখিয়ে চলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন বেসামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তবে প্রকৃত ক্ষমতা থাকছে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের হাতে।
সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা সাধারণ আন্দোলনকারী, ব্লগার ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর প্রযুক্ত হয়েছে, তবে গণমাধ্যম তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু। পাকিস্তানের সবচেয়ে পুরনো ইংরেজি সংবাদপত্র ডনের কথাই ধরা যাক। হুমকি, নিষেধাজ্ঞা, সেন্সরশিপের খাঁড়া—কোনটি প্রয়োগ করা হয়নি তাদের ওপর! সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও রাজনীতিকদের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। শাস্তি হিসেবে দেশের সব সামরিক ঘাঁটিতে ডনের বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টিভি প্রভাইডাররা তাদের চ্যানেলের সম্প্রচার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে; সর্ববৃহৎ প্রদেশ বেলুচিস্তানের অনেক জায়গায় পত্রিকাটি পাওয়া যায় না।
জাতীয় গণমাধ্যমগুলো অন্ধকারে ডুবে গেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফিডম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৯ নম্বরে। সেনাবাহিনীর নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার মতো সব সংবাদের সম্প্রচার নিজে থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে অনেক টিভি স্টেশন। গত দুই বছরে অনেক সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী উধাও হয়েছে, অপহৃত হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর ছাড়া পেয়ে ভয়ে তারা কেউ বলেনি—কারা, কেন অপহরণ করেছিল।
দুর্নীতির মামলার জেরে উত্খাত হওয়ার আগে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরিফ। লন্ডনের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট কেনার অর্থের উৎস দেখাতে না পারায় দুর্নীতিবিরোধী আদালত গত ৬ জুলাই শরিফকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। শরিফ ও তাঁর দল দাবি করছে, তিনি বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর চক্রান্তের শিকার। এর মধ্যেই পিএমএলের (নওয়াজ) কয়েকজন নির্বাচনী প্রার্থীকে অন্য দলে যোগ দিতে অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বলেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠতা আছে বলে ধারণা করা হয়।
সেনাবাহিনী মানুষকে বলার চেষ্টা করছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা দেশের বারোটা বাজিয়েছেন। তারা রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে এবং সামরিক শাসন জারির বদলে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করছে। এ অভিযানের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট বছরের শুরুতে সব নির্বাচনী প্রার্থীকে সম্পদের হিসাব দিতে বলে। তবে যেসব দল ও রাজনীতিক সেনাবাহিনীর সমালোচনা থেকে বিরত ছিল, তাদের ব্যাপারে কোনো তদন্ত হয়নি। তদন্ত থেকে রেহাই পাওয়া দলগুলোর মধ্যে রয়েছে পিটিআই ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর সন্ত্রাসী হামলার পাকে পড়া পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ খুব কম। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বড়জোর দুর্বল একটি জোট সরকার গঠিত হতে পারে। আর এটাই চায় সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ।
পিএমএলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খান। তাঁর দলে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট অনেক প্রার্থী আছেন। খান সেনাবাহিনীর পছন্দের ব্যক্তি হলেও তাঁর জনপ্রিয়তা দেশের উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। অন্য দল থেকে আসা অনেক দুর্নীতিবাজ ও প্রবীণ রাজনীতিককে নিজের দলে জায়গা দিয়ে তরুণ সমর্থকদের সমর্থন হারিয়েছেন তিনি। পিপলস পার্টির জনপ্রিয়তা এখন সিন্ধু প্রদেশেই সীমাবদ্ধ।
বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় নির্বাচনী প্রার্থীদের ওপর বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। দুই প্রার্থীসহ ১৭০ জন মারা গেছেন। এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানি তালেবান ও অন্য চরমপন্থী দলগুলো। তাদের দমন না করে উল্টো মূলধারার রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনী। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন বেশ কয়েকটি চরমপন্থী দলকে নতুন নামে ও পরিচয়ে নির্বাচন করার অনুমোদন দিয়েছে। নিষিদ্ধ লস্কর-ই-তৈয়বার ২০০ প্রার্থী আল্লাহু আকবার তেহরিকের হয়ে নির্বাচন করছেন। শিয়াবিরোধী মৌলবাদী দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতা আওরঙ্গজেব ফারুকি পাকিস্তানের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। তাঁরা কেউ হয়তো জিতবেন না কিন্তু তাঁদের চরমপন্থী স্লোগান ও কৌশল সংশ্লিষ্ট আসনগুলোর নির্বাচন বরবাদ করে দিতে পারে।
পাকিস্তানে নির্বাচনের পরই প্রতারণা আর কারচুপির ভূরি ভূরি অভিযোগ ওঠে। এবারের আশঙ্কা হলো, নির্বাচনের আগেই কারচুপির চেষ্টা হতে পারে, আদালত-সেনাবাহিনী জোট বহু প্রার্থীকে আগেই বসিয়ে দিতে পারে। আরেকটা ভয় আছে—অনাচারের শিকার রাজনৈতিক দলগুলো ফল প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তখন অস্থিতিশীল বাহ্য প্রতিবেশের কারণে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা হয়তো সামাল দিতে পারবে না পাকিস্তান। সব পক্ষকে এক হয়ে একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করা সময়ের দাবি।
লেখক : পাকিস্তানি সাংবাদিক
সূত্র : ফরেন অ্যাফেয়ার্স
ভাষান্তর : শামসুন নাহার