Tue. May 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খোলাবাজার২৪ সোমবার ৩০ জুলাই, ২০১৮ : আজ দেশের তিন গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। প্রায় এক মাস ধরে তিন সিটির মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলেছে। গোটা  দেশের মানুষ আসলেই কতটা এই নির্বাচন আগ্রহসহ পর্যবেক্ষণ করছে তা না বলা গেলেও রাজনীতি-সচেতন সব মহল কেমন নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

আগেই বলে রাখি, ২০১৩ সালে এই তিনটিসহ মোট পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা বিস্ময়কর জয় পেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। অথচ তাঁরা সবাই নিজ নিজ সিটি করপোরেশনে কাজের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। তার পরও তাঁদের হারতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘ধর্মবিরোধী’ প্রচারণার সুফল ঘরে তুলেছিল বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা। অতীতের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালেও এমন সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় বিএনপি এবং দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বিজয় পাওয়ার বিষয়টি কতখানি গণতন্ত্রের চর্চাকে রাজনীতিতে নিরুৎসাহ করে, তা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। যারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে ধর্মের নামে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়, নিয়ে সুফল পায় তারা যেমন গণতন্ত্রের বিকাশের পিঠে ছুরিকাঘাত করে, একই সঙ্গে যারা এ ধরনের প্রচারণায় ভীষণভাবে বিভ্রান্ত হন তাঁরাও কিন্তু উল্টো পথে দেশের গণতন্ত্র হাঁটার দায় একেবারেই এড়াতে পারেন কি না তাও ভেবে দেখার বিষয়।

নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয়, একই সঙ্গে গণতন্ত্রের ভাবাদর্শের সঙ্গে যায় না এমন প্রচার-প্রচারণা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাজিমাত করার বাস্তবতা খুবই নেতিবাচক ও ক্ষতিকর—এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন উল্লিখিত বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের দুর্বলতার অন্যতম দিক হচ্ছে ধর্মের অপব্যবহার, মানুষকে সম্মোহিত করার নানা অপকৌশলের প্রয়োগ, অর্থবিত্ত ও সন্ত্রাসীদের পেশিশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে তা বুঝতে হবে। সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং ভোটারসহ সবারই দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রচর্চায় গণতান্ত্রিক নর্মস মেনে চলা, অগণতান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতি কবে হবে, সেটিই বিবেচ্য বিষয়।

এবার পরিস্থিতি ২০১৩ থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। সাম্প্রদায়িকতার জিগির এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে না। ফলে গণতন্ত্রের পথে হাঁটার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণেই সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর অবস্থান, মিডিয়া, ভোটারসহ সবারই অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার চিন্তা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। সরকারের সম্মুখে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে সহযোগিতা করা, সরকারের ভাবমূর্তি তুলে ধরা। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির স্থাপনে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা। এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে সরকারের বিরুদ্ধশক্তি তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির সুযোগ নেবেই। সেই পরীক্ষা সরকারকে দিতে হচ্ছে, দিতে হবেও।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তিন সিটি করপোরেশ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো ভাবমূর্তি নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করা। তবে যে যত কথাই বলুক, বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীরা নির্বাচনে নেমে যাওয়ার পর একদিকে প্রতিশ্রুতির বহর এতটাই বাড়িয়ে দিতে থাকেন, যা তাঁদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব কি না তা ভেবে দেখেন না, অন্যদিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ করতেই থাকেন। বিশেষত মূল প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনী আচরণবিধির কথাও ভুলে যেতে দ্বিধা করেন না। বিশেষত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এনে মাঠ গরম রাখতে চান, ভোটারদের সহানুভূতি ভোট আদায় করতে চান, নিজে পরাজিত হলে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চান। আসলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নানা রাজনৈতিক সমীকরণ ও কৌশল কাজ করে। যেমন—এবারের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের প্রায় সবাই দাবি করে থাকেন যে নির্বাচনে তাঁদের অংশগ্রহণের একমাত্র উদ্দেশ্য জয়লাভ নয়, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের চরিত্র উন্মোচন করা। এর অর্থ দাঁড়ায়, যদি নির্বাচনে তাঁরা পরাজিত হন. তাহলে কারচুপির নির্বাচনের অভিযোগ এনে পরবর্তী  জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বড় ধরনের আন্দোলন দাঁড় করানো। তাতে সফল হলে গণজোয়ারে তাদের সহজ বিজয় নিশ্চিত হয়ে যাবেই- প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে যা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কারণে অনিশ্চিত থাকে। তা ছাড়া সরকারি দলের প্রার্থী, কর্মী-সমর্থকরাও বিরোধী দলের নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগের মাত্রা বেশি হলে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক  চাপেও থাকে। ফলে কোনো কোনো নির্বাচনী কেন্দ্রে তাদের অসংযত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েও থাকে। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন অনভিপ্রেত ঘটনাই বিরোধী দলের প্রচার-প্রচারণার সুযোগ করে দেয়, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়—এটি তারা আমলে নিতে চায় না। খুলনা বা গাজীপুর নির্বাচনে যে কয়টি কেন্দ্রে বুথ দখল ও জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল সে কয়টি না ঘটলেও জয়-পরাজয়ের   মূল প্রবণতায় হেরফের হতো না। তার পরও সরকারি দলের কিছুসংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল কর্মীর অবিমৃষ্যকারিতার ফলে গোটা নির্বাচনের গায়ে কলঙ্কের ছাপ লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। সবাই আশা করে যে সিলেট, রাজশাহী ও বরিশালে তেমন কিছু ঘটতে দেওয়া হবে না। এটি শুধু বিরোধীদেরই প্রচারের খোরাক হয়ে যায় না, মিডিয়াগুলোরও  আলোচনা-প্রচারের বিষয় হয়ে ওঠে, যা সরকারের ভাবমূর্তির ওপর ছাপ ফেলে। যেহেতু সম্মুখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই সরকারের উচিত হবে একটি কেন্দ্রেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর মতো পরিস্থিতি কেউ যাতে সৃষ্টি না করতে পারে সেদিকে সজাগ  থাকা।  গাজীপুর  ও রাজশাহীতে বিশৃঙ্খলা ঘটানোর গোপন পরিকল্পনার অডিও ফাঁস হওয়ার পর বুঝতে বাকি থাকে না যে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা কৌশল নিয়ে অনেকেই অপরাজনীতি করতে দ্বিধা করে না। সেই সুযোগ নিতে কারা, কেন এত তৎপর, সেটি বুঝতে হবে। সে কারণেই নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করার চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে বিশেষভাবে নিতে হবেই। অন্যদিকে গাজীপুর ও রাজশাহীর ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে দেশব্যাপী জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বিরোধী দলের নির্দোষ অভিযোগও খুব একটা জনসমর্থন পাওয়ার অবস্থানে ছিল না, তাদের অভিযোগ তাদের কর্মকাণ্ডেই জনসমর্থন পায়নি। সুতরাং নির্বাচনে বিরোধী দলের পরীক্ষাও কম হয় না, দলীয় সমর্থকের বাইরের ভোটারদের বড় অংশই এখন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে আগের মতো বিভ্রান্ত হয়ে যায় না। ধারণা করা যায়। ধারণা করা হচ্ছে যে এবার ভোটার নিজ নিজ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেবে, ভোটদানে সেভাবেই মেয়র ও কাউন্সিলর ভোট প্রদান করবে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরীক্ষাটি আমাদের দেশে অপ্রচার, ধর্মীয় অনুভূতি, ভয়ভীতি, অর্থের ছড়াছড়িসহ নানা ধরনের পরিপন্থী পরিবেশ তৈরি করা হয়। ফলে সাধারণ ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাচনে ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য সাধনের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরে যায়। শুধু স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেই নয়, জাতীয় নির্বাচনে ধর্মীয় জিগির তুলে যেভাবে আবেগ সৃষ্টি করে ভোট নেওয়ার আবহ তৈরি করা হয় তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্বাচন ও গণতন্ত্রও। দীর্ঘ নির্বাচনী অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যে শিক্ষাটি পাই, তা হচ্ছে আমাদের দেশে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মানের ধারেকাছেও না পৌঁছাতে পারার প্রধান কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল চেতনাপরিপন্থী প্রভাব বিস্তারকারী জুজু, ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা, অর্থ ও টাকা-পয়সার বিনিময়ে ভোট পাওয়ার চেষ্টা, মিথ্যা আশ্বাস ইত্যাদি। আমরা বাহ্যিকভাবে যত শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার কৃতিত্বই নিই না কেন, তাতে গণতন্ত্র আখেরে পরাজিত হবে যদি তাতে গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির বিজয়ের পথ রুদ্ধ করা না হয়, গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদের অবস্থান নিশ্চিত করা না হয়। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের পথে চলার বৈধ উপায়। সেই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের পেছনে যদি থাকে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, সাম্প্রদায়িকতা, অর্থের ছড়াছড়ি, পেশিশক্তির দাপট—তাহলে শেষ বিচারে পরাজিত হয় গণতন্ত্রই। সে কারণে সরকার, বিরোধী দল ও সাধারণ ভোটারসহ সব পক্ষকেই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি, কোনো সংকীর্ণতা নয়, মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের  সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ আচরণই হচ্ছে একমাত্র উপায়। তাহলে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সহজে বাস্তবায়ন করা যায়—যা উন্নত গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় করা সম্ভব হচ্ছে, আমাদের এখানে দিল্লি মনে হচ্ছে বহু দূরেই রয়ে গেছে। আমরা আশা করব তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও ভোটাররা গণতন্ত্রের স্পিরিটের সঙ্গেই থাকবে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার পথ তৈরি হবে। সেটিই সবার কাম্য।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়