খোলাবাজার২৪.মঙ্গলবার,৩১ জুলাই, ২০১৮ঃ বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ও প্রখ্যাত তথা বিরল সুকথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী চলে গেলেন। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন কবি সুবোধ সরকার "খুব বড় মাপের লেখক। ওদিকে জন্মালে মার্কেজের পাশের চেয়ারে বসতেন। লিখতেন কম। বছরে একটি উপন্যাস। কোন সাহিত্য সভায় যেতেন না। সভাপতি হতেন না। প্রধান অতিথি হতেন না। গল্ফ গ্রিনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি ৯১ বছর বয়েসেও সিগারেট খেতেন।
কী সব লেখা লিখেছেন। একখানা 'খারিজ' একখানা 'বনপলাশীর পদাবলী' একখানা 'বাড়ি বদলে যায় ' লিখতে পারলে ইওরোপের লেখকদের আর মাটিতে পা পড়ে না। তিনি আমাদের নির্জন হেমিঙওয়ে। অথচ কী আশ্চর্য তিনি নিজেই বলেছেন তাঁর গদ্যে জীবনানন্দ আছেন। আনন্দবাজারে নীরেনদার ঘরে গেলে ওঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। আমি প্রণাম করি তাঁর ডানহাতের পাঁচটা আঙুলকে এবং তাঁর অবিনশ্বর বাংলা ভাষাকে। খিদিরপুর ছেড়ে একটা বড় জাহাজ চলে গেল।"
"স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন স্কুলের মাঠে চট ঘেরা সিনেমা হলে প্রথম দেখি 'বনপলাশীর পদাবলী' সিনেমা। বুঝতে পারিনি। কিন্তু কী একটা রেশ থেকে গিয়েছিল মনে। 'উদাস বাউল নেই রে বাউল আর', 'আট্টা মা', সুপ্রিয়া দেবীর মাছ হয়ে জলে সাঁতার আর সেই বিখ্যাত গান 'দেখুক পাড়া পড়শিতে কেমন মাছ গেঁথেছি বড়শিতে'… একটা ঘোর তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে সেই বয়সেই। বড়ো হয়ে তাই বার বার দেখেছি। প্রান্তিক জীবনের টানাপোড়েন, ভালোবাসা আর কেউ এমন তুলিতে আঁকতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সম্পাদক হিসেবে দেশ পত্রিকাকে আলাদা উচ্চতায় দাঁড় করিয়ে ছিলেন তিনি। চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের সেই গুরু রমাপদ চৌধুরী।
তাঁকে আমার বিনম্র প্রণাম!" বলছিলেন কথাসাহিত্যিক লালমিয়া মোল্লা। রমাপদ চৌধুরীর জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে। তিনি প্রয়াত হলেন ২৯ জুলাই ২০১৮। এই স্বনামধন্য লেখক পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের খড়গপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। দীর্ঘদিন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা শুরু করেন। তাঁর অনেক গল্প নিয়েই চলচ্চিত্র হয়েছে প্রচুর। তার মধ্যে বনপলাশির পদাবলি, এখনই, খারিজ, একদিন অচানক, সুন্দরী উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৮ সালে তিনি "বাড়ি বদলে যায়" উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়াও পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার ও রবীন্দ্র পুরস্কার। কলকতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ও পদক। শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্যও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। যুগান্তরে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্প ‘উদয়াস্ত’৷ তার পর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় ‘বারো ঘোড়ার আস্তাবল’৷
রমাপদ চৌধুরীর প্রথম গল্পের নাম ‘ট্রাজেডি’। ১৯৪০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বয়স আঠারো বছর। কলেজ পালানো এক দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের ওয়াইএমসিএ-র নীচের রেস্তোরাঁয় বসে লেখেন গল্পটি। দুই হবু-সাহিত্যিক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে লেখা। গল্পটি ছাপা হয় ‘আজকাল’ সাপ্তাহিকে। সেই শুরু। তার পর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ ও হুমায়ুন কবীরের ‘চতুরঙ্গ’ ত্রৈমাসিকের নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। পঁচিশ বছর বয়স থেকেই তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও শারদীয় আনন্দবাজারের স্থায়ী লেখক হয়ে যান। সময়টা তখন চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ, ১৯৪৭-’৫০। এটাই গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর উন্মেষ কাল। তখন নিজেই ‘ইদানিং’ ও পরে ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। এ সময়ের মধ্যেই লিখে ফেলেছেন বেশ কিছু সার্থক গল্প।
ইতিমধ্যে তিনি দেখছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ কঠিন দৃশ্য, যুদ্ধের পরের দাঙ্গা, দেশ বিভাগের ফলে বসতভিটা ফেলে অশ্রুসজল চোখে মানুষের চলে যাওয়া, চোখের জলে তাদের বিদায় দিতে দিতে চোখের সীমানায় উদ্বাস্তু, বাস্তুত্যাগী মানুষের আগমন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কলকাতার বুকে মন্বন্তরের বীভৎষ্যতা। স্বাধীনতার প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস আর অসারতা। এর মধ্যে দিয়ে লতিয়ে উঠছে গণবিক্ষোভ, বামপন্থী রাজনীতির উত্থান। ঘটছে মধ্যবিত্তের বিকাশ। সমাজে মধ্যবিত্তের মানসিকতার প্রভাব-দোলাচল, অনিশ্চয়তা, হতাশা, প্রতারণা ইত্যাদি দেখা যায়। এ সব কিছু গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর মানসভূমে সাহিত্যের ভাষা ও বিষয়বস্তু তৈরি করছিল নিশ্চয়ই। তার গল্প-উপন্যাসে এসব এসেছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও সরাসরি, কখনও প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তবে তার গল্পে একটি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ পায়। যে কারণে তিনি বিভিন্ন ভাবে সমাজের কপটতাতে আঘাত করেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন সে ভাবেই। গল্প দিয়েই রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্য যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে তিনি সার্থক উপন্যাসও রচনা করেছেন একাধিক। তবে উপন্যাস ও গল্পের বিষয়বস্তু আলাদা। তিনি খুব সচেতন হিসেবে এর প্রকরণ করে থাকেন। ঔপন্যাসিকের কাছে গল্পকারের দৃষ্টিভঙ্গির কৃতিত্ব কোথায় তাও তিনি নির্ণয় করেছেন। তিনি একটি মহাযুদ্ধের দৃশ্যকল্প সামনে এনে বুঝিয়ে দেন সেই কৃতিত্ব। যুদ্ধের বিশাল-বিরাট আয়োজন, পুঙ্খানুপুঙ্খু বর্ণনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা ঔপন্যাসিকের কাজ। এখানে গল্পকারের কৃতিত্ব কোথায়? রমাপদ চৌধুরী লেখেন —‘হঠাৎ তিনি ছোটগল্প-লেখককে দেখতে পাবেন বনের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন্ উন্নাসিক লেখক?-মনে মনে ভাবলেন ঔপন্যাসিক। কোনও মিনারের চূড়ায় উঠলো না দেখলো না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিলো না, এ কেমন ধারা সাহিত্যিক! হয়তো এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়তো, না বন্ধু, এ সব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। বনের ওপারে কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার বিন্দু ফুটে উঠেছে — কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথাবিন্দুর, চোখের টলোমলো অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন হয়তো, বন্ধু হে, ওই অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।’ (ভূমিকা/রমাপদ চৌধুরী-গল্পসমগ্র)
তাঁর রচিত কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ আকাশপ্রদীপ, অহংকার, আজীবন, অংশবাড়ি, বদলে যায়, বাহিরি, বনপালাশির পদাবলী, বেঁচে থাকা, চড়াই, ছাঁদ, সুন্দরী সুখ দুঃখ প্রভৃতি। তথ্যসূত্র: উইকপিডিয়া।
বাংলা সাহিত্যের পাঠকমহলে তিনি গভীর ভাবে দাগ কেটেছেন। বাংলার সাহিত্যাকাশে তিনি এক বিশাল জায়গা জুড়ে উদার আকাশ হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্য সেবায় রমাপদ চৌধুরী একজন সৎ সাহিত্যিক হিসেবে যে অফুরন্ত অবদান রেখে গেলেন তা বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য পরিসরকে সমৃদ্ধ করবে বহুকাল।