Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলাবাজার২৪.শনিবার ,০১সেপ্টেম্বর ২০১৮ : মোঃ রাসেল মিয়াঃ নরসিংদী প্রতিদিন : গত ২১ আগস্ট ঈদুল আজহার আগের দিন নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানার মেঘনা নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল চরদীঘলদী ইউনিয়নের অনন্তরামপুর গ্রামে আওয়ামীলীগের দুইটি পক্ষের মধ্যে টেঁটাযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে মোহাম্মদ আলী (২৮) নামের একজন নিহত হন। মোহাম্মদ আলী ছিলেন ওই ওয়ার্ডের সভাপতি আলমগীর হোসেন পক্ষের সমর্থক। সেসময় টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন দু’পক্ষের আরও ১৫ জন। এই ঘটনার জের ধরে অপরপক্ষ মিয়াচাঁন ব্যাপারীর ও সাবেক ইউপি সদস্য নেওয়াজ আলী সমর্থক প্রায় ৩০০ পরিবার ঈদুল আজহার আগের দিন থেকেই গ্রামছাড়া। তারা এখন শরনার্থী, পাহাড়িয়া ঢলের মত নদী পেরি য়ে আশ্রয় নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুরের শান্তিপুরে।জানা গেছে, নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানার মেঘনা নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল চরদীঘলদী ইউনিয়ন। নরসিংদী সদরের মাধবদী থানার মেঘনা বাজার ঘাট থেকে নৌকা বা স্পিডবোট ছাড়া যাতায়াতের আর কোন বিকল্প নেই। অননÍরামপুর গ্রামে বসবাস করেন প্রায় ৭শ পরিবারের প্রায় ২০০০ মানুষ। গ্রামটির প্রায় প্রতিটি পরিবারেই আছেন একজন বা দুজন প্রবাসী। টেঁটাযুদ্ধপ্রবণ অনন্তরামপুর গ্রামটি পড়েছে চরদীঘলদী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের আওয়ামীলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মিয়াচাঁন ব্যাপারী। তারা দুজনেই চান এলাকায় নিজের আধিপত্য নিশ্চিত করতে। এই আধিপত্যের দন্দ্বে দীর্ঘদিন ধরে তারা পরষ্পর সদলবলে টেঁটাযুদ্ধে লিপ্ত। গ্রামে তাদের ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তারের বলি হচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসী।পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, নরসিংদী সদর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল চরদীঘলদী ইউনিয়নের অনন্তরামপুর গ্রাম। এই গ্রামের আওয়ামীলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেনের সাথে সাধারণ সম্পাদক মিয়াচাঁন ব্যাপারীর আধিপত্যের দন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দন্দ্বে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই দল গ্রামবাসী। বাঁধে রক্তক্ষয়ী টেটাযুদ্ধ। বেশ কয়েকবার স্থানীয় প্রশাসন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মিমাংসা করলেও কোন ফল মেলেনি। ঈদের আগের দিন সকালে আধিপত্যের দ্বন্দেজড়িয়ে পড়ে আবারো সংঘর্ষে। সেই সংঘর্ষে আলমগীর হোসেনের পক্ষের মোহাম্মদ আলী নামের একজনের মৃত্যু হয়। তখন থেকেই ভাংচুর ও লুটপাট হতে থাকে দুই পক্ষেরই বাড়িঘরে।চরদীঘলদী এলাকার বোরহান উদ্দীন নামের একজন জানান, গত দশদিন ধরে মিয়াচাঁন পক্ষের কোন লোক এলাকাতে নাই। এই সুযোগে অপর পক্ষের লোকজন লুটপাট ও ভাংচুর করছে। সারাবছরই হয় এই পক্ষ নতুবা ওই পক্ষ আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এলাকায় পুলিশ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। কিছুদিন পরপরই টেঁটাযুদ্ধের ঘটনায় এই এলাকার একজন হিসেবে লজ্জা লাগে।সরেজমিনে বাঞ্ছারামপুরের শান্তিপুর গ্রামে আশ্রয় নেওয়া অন্তত ৭০ জনের সাথে কথা হয়। তারা জানান, ওই গ্রামে কিছুদিন পরপরই দফায় দফায় দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও টেঁটাযুদ্ধ হয়। এই বিরোধ থামাতে প্রায়ই দুইপক্ষের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সমঝোতা বৈঠক হওয়ার আগেই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র আর টেঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। এতে গত একবছরে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ জন। সর্বশেষ ২১ আগস্টের ঘটনায় একজন মারা গেলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই ঘটনার আগে আলমগীর হোসেনের সমর্থক ৬/৭ টি পরিবার গ্রামছাড়া ছিল। ঈদ করতে গ্রামে ফেরেন তারা। ফিরেই আবার সদলবলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে আলমগীর হোসেনের সমর্থকদের হামলায় গ্রামছাড়া আছেন মিয়াচাঁন ব্যাপারীর সমর্থকরা। শিশু ও নারীসহ ৩০০ পরিবারের প্রায় ৭০০ লোক এখানে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছেন। তারা তাদের গ্রামে ফিরে যেতে চান।ঘটনার দিন আলমগীর পক্ষের হামলায় টেঁটাবিদ্ধ হাবি মিয়া জানান, ঈদের আগের দিন আলমগীর পক্ষের লোকেরা গ্রামে আসে। তারাও অনেকদিন গ্রামছাড়া ছিল। এসেই সেদিন রাতে সংঘবদ্ধ হয় আমাদের বাড়ির চারদিকে ঘুরছিল। হানিফ মেম্বার নামের একজন আমাকে তার সাথে গিয়ে কথা বলতে বলে। সকালে তার সাথে দেখা করতে গেলেই আমাকে সবাই মিলে ধরে ফেলে। পালিয়ে গিয়ে চৌকির তলায় আশ্রয় নিলে সেখানে খুব মারধর করা হয় আমাকে। কিছুক্ষণ পরেই টেঁটা ি নয়ে এসে আমার হাতে আঘাত করে, দা দিয়ে কোপায়। এরপরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।অনন্তরামপুর গ্রামের ইউনুস মেমোরিয়াল স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আনোয়ার জানায়, ইস্কুলে গেলে আমগরে মারাধরি কইরা বাইর কইরা দেয়। এই সব কাইজার লাইগা আমগর স্কুলে আমরা যাইতে পারি না। কয়দিন পরেই তো পরীক্ষা। কেমনে কি অইবো জানি নাশান্তিপুরে আশ্রয় নেওয়া খোদেজা বেগম নামের একজন জানান, চারমাসের নাতিনরে তারা আমার কোল থেকে টেনে নিয়ে যায়। আমার মেয়ে ও আমি অনেক কান্নাকাটি করলেও তারা নাতিনকে দেয় নি। তারা আমাদের বাড়িঘর কোপাইয়া, যা আছিল গরু-ছাগল, ধান-চালসহ সব নিয়া গেছে। আমার বাড়ির চারটা ঘর ভেঙে দিয়েছ তারা। পালিয়ে ট্রলারে করে শান্তিপুর গ্রামে আসছি। এখানে মানুষের বাড়িঘরে চেয়ে চেয়ে খাচ্ছি আর কোনরকমে দিন কাটাচ্ছি। গ্রামে যাতে আমরা আবার ফিরে যাইতে পারি তার ব্যবস্থা কইরা দেন। চরদীঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের (৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড) সদস্য ও মিয়াচাঁন ব্যাপারীর সমর্থক মনোয়ারা বেগম জানান, আমরা চাইছিলাম এতদিন যা হইছে সব বাদ দিয়া শান্তি আসুক। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে যে এমন ছিল কে জানতো? সকালবেলায় তারা হৈ করে চিৎকার করতে করতে আমাদের বাড়িঘরে হামলা করে। তখন আমাদের লোকজন বাধা দিলে সেসময় কয়েকজন টেঁটাবিদ্ধ হয়। তাদের স্পিডবোটে নরসিংদী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে শুনি একজন মারা গেছে। মারা গেল কিভাবে এটাই তো বুঝতে পারছিনা। তার লাশ নাকি ঘরের কার থেকে নামানো হইছে। তারা আমাদের গ্রাম থেকে সরিয়ে দিতে এসব ষড়যন্ত্র করতাছে।একজন আশয়দাতা ও বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান সরকার বলেন, গত বারদিন ধরে আমাদের এক-একটি বাড়িতে ৩০ থেকে ৫০ জন করে থাকছে তারা। আমাদের আত্মীয়স্বজন হয় বলে কোনরকমে মিলে মিশে থাকতে দেওয়া যাচ্ছে। নরসিংদীর প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, সমস্যা সমাধান করে তাদেরকে নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া হোক।আলমগীর হোসেন ও মিয়াচাঁন ব্যাপারী এই দুজনের সাথেই কথা বলার চেষ্টা করেন । তারা এলাকায় থাকছেন না। তাদের মুঠোফোনে অনেকবার চেষ্টা করেও তাদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয় নি। নরসিংদীর বিভিন্ন চরাঞ্চলসহ বিশেষ করে বিছিন্ন বা দুর্গম এলাকাগুলোতে টেঁটাযুদ্ধ একটি অমানবিক সংস্কৃতি হয়ে দড়িয়েছে। হাতেগুনা গুটিকয়েক ব্যক্তির ক্ষমতার দ্বন্দে এই ভিলেজ পলিটিক্স। দেখা যাচ্ছে, অশিক্ষিত এবং অসচেতন গ্রামবাসীরা এর বলি হচ্ছে। এতে চাকরি ও বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। গ্রামের অসহায় সরল এই মানুষগুলো নিজেরা কি পাচ্ছে, এই বোধ যদি জাগ্রত না হয়তবে সমাধান খুব কঠিন। শুধু আইন প্রয়োগ করে বহু বছরের এই সমস্যার সমাধান হবে না।নরসিংদী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহরিয়ার আলম জানান, আমি শুনেছি, প্রায় ৩০০ পরিবার নদী পেরিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের শান্তিপুরে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি নিরীহ গ্রামবাসীদের স্বস্তি ফিরি য়ে গ্রামে নিয়ে আসার। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের সেজন্য অনন্তরামপুর গ্রামে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। আর যারা মামলার আসামী তাদের বিরুদ্ধে আমরা তদন্ত করছি। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমস্যা সমাধানে স্থানীয় গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের সাথেও কথা বলেছি।