খোলাবাজার২৪. শনিবার ,০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ : একজন প্রসিদ্ধ লোকের আত্মজীবনীতে মনে রাখার মতো একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছিল। লেখক তাঁর ছোট বয়সের একটি কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর বাবাকে একটি গ্রাম্য সালিসে হাজির হতে হয়েছিল। তখনকার শিশু বালক, পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ লেখক, সেই সালিসি মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। সালিসি সভায় লেখকের বাবাকে অন্যায়ভাবে অপমান করা হয়েছিল। লেখক এতে দুঃখ পেয়েছিলেন। লেখকের ভাষ্য মতে তার চেয়েও অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন এই কারণে যে তাঁর বাবা এত বড় অন্যায় অপমানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি। বিনা বাক্য ব্যয়ে, নীরবে সে অপমান সহ্য করেছিলেন। নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ কিশোর মনে কলুষতা থাকে না। অন্যায় কাজ সহ্য করতে তার কষ্ট হয়। ভেতরে ভেতরে সে ফুঁসে উঠতে থাকে। সালিসের অন্যায় সিদ্ধান্ত এবং তাঁর বাবার মুখ নিচু করে সেই অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়া তথা প্রশ্রয় দেওয়া তাঁর বিক্ষুব্ধ মনে দাগ কেটেছিল বলেই পরিণত বয়সে তাঁর লেখায় ঘটনাটি জোর-কলমে প্রকাশ পেয়েছে।
অন্যায়, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, জুলুম ইত্যাদি দেখলে একজন কিশোর, তরুণের মন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সহজ-সরল অনুভূতি দিয়ে সে ন্যায়-অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার নির্ধারণ করে। আইন-কানুন, বিধি-বিধানের মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। কখনো কখনো, বলা যায় কদাচ সে একাই প্রতিবাদ করে। নাটকে-সিনেমায় প্রতিবাদী তরুণের তৎপরতা দেখা যায়। বেশির ভাগ সময় সে ব্যর্থ হয়, মাঝেমধ্যে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী কর্তৃক দমন-পীড়নের শিকার হয়। আইন-কানুন, মামলা-মোকদ্দমার ঘোরপ্যাঁচে ফেলে তার জীবন দুর্বিষহ করা হয়। সে কারণে মনে মনে প্রতিবাদী হলেও প্রকাশ্যে কিশোর-তরুণকে সব সময় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তৎপর হতে দেখা যায় না। বিক্ষোভ মনের মধ্যে চেপে রাখে।
দু-একটি ঘটনা কিশোর-তরুণের মনপ্রাণ, অনুভূতিকে এত জোরে নাড়া দেয় যে তার পক্ষে নীরব, নির্বিকার, নিস্তেজ, নিষ্ক্রিয় থাকা সম্ভব হয় না। সে প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৎপর কর্মচঞ্চল রূপ ধারণ করে। যদি এর সঙ্গে তার বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, সহযোগী এসে যুক্ত হয়, তবে এই সম্মিলিত গোষ্ঠী সরব প্রতিবাদী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সম্মিলিত প্রতিবাদী গোষ্ঠী কোনো বাধা মানতে চায় না, সদলবলে শুধু প্রতিবাদী আওয়াজ তুলে এগিয়ে যেতে চায়। এদের কোনো পিছুটান নেই। খাওয়া-পরার চিন্তা এদের ভারাক্রান্ত করে না। প্রকৃতপক্ষে এসব চিন্তা তাদের মাথায় আসে না। স্বল্পকালীন যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের চিন্তা অভিভাবকের ওপর ছেড়ে দিতে তারা অভ্যস্ত। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে তারা সময়ের দাবি বলে মনে করে। সেই দাবির প্রতি সাড়া দেওয়াকে তারা মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মহত্তম কাজ বলে মনে করে। দমন-পীড়ন, কষ্ট-যন্ত্রণা যতই আসুক না কেন, এ কাজ তাদের করতেই হবে, এমন বদ্ধমূল ধারণা থেকে প্রতিবাদী কিশোরের দলকে তখন সরানো যায় না। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়েও তারা থাকে অটল, অকুতোভয়।
কিছু অতি উৎসাহী বিশ্লেষক ও তাৎক্ষণিক মন্তব্যকারী কিশোর ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ইতিহাসের অভূতপূর্ব কিশোর বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এসব বক্তব্য পর্যালোচনার উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে। পর্যালোচিত হলে প্রামাণ্য তথ্যের ধোপে তা কতদূর টিকবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যা করেছে, তা অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমরা, মানে আমাদের সমসাময়িক ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পরিচালিত একাধিক ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। যেমন—শিক্ষা আন্দোলন, কনভোকেশনবিরোধী আন্দোলন, উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি। সেদিনের হাড়ভাঙা, মাংস থেঁতলানো ছাত্ররা সরকারের পোষা এনএসএফ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ঠুর নিপীড়নের শিকার হয়েও আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে। সেই ছাত্রদের অনেকেই আজ শাসকদল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ছাত্রদের মতো সেদিনের ছাত্ররা, যাঁর মধ্যে (শহীদ) মতিউরের মতো স্কুলছাত্রও ছিলেন, নিষ্ঠুরতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এটাই স্বাভাবিক। এরূপ না হলে তাকে বলা যেত ইতিহাসের ব্যতিক্রমি ঘটনা। যে কিশোর-তরুণের টগবগে রক্ত, যে শুধু সামনে দেখতে পায়, পেছনের পথ যার কাছে অপ্রাসঙ্গিক তারই প্রতিবাদ করার সময়। ‘যুদ্ধে যাবার সময়’।
আমরা যারা যৌবন পেরিয়ে এসেছি, ঘরসংসারে রুটিন জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়েছি, বাস্তবতার দাবি যাদের বারবার পিছু টানছে, একই সঙ্গে যাদের হাঁটুতে টান ধরেছে, তাদের কাছে প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড, এমনকি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও আশা করা ঠিক হবে না। বলা হয়, ২৫ বছরের আগে যে যুবক সমাজতান্ত্রিক (Socialist) ধারায় বিশ্বাসী নয়, তার মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হওয়া দরকার; ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যে প্রৌঢ় ব্যক্তি সমাজতান্ত্রিক, তাকেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো সমীচীন হবে। যেসব বয়স্ক লোকের কথা আমরা চিন্তা করছি, তাদের ঘরসংসার আছে, সহায়সম্পদ রয়েছে, তারা সবাই নিম্ন হোক, উচ্চ হোক মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত। সংসারের স্বার্থে, সম্পদের লোভে-মোহে তারা অপমান, নিগ্রহ, অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করবে। মুখ খুলে প্রতিবাদ করবে না। তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা প্রতিবাদ করলেও তারা ভয় পাবে, প্রজন্মকে নানা অজুহাতে ঘরে আটকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। তারা নিরাপদ সড়ক চাইবে; কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রজন্মকে আন্দোলনে অংশ নিতে বারবার অনীহা প্রকাশ করবে।
কিশোর ছাত্ররা যখন প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দেয় তখন তারা এত বিক্ষুব্ধ এবং আবেগাপ্লুত থাকে যে তাদের কাজের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করার সময় থাকে না। চিন্তা করার প্রয়োজনও তারা অনুভব করে না। পুরো বিষয়টা তারা অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। ছাত্র অবস্থায় আমাদের মন-মানসিকতা একই রকম ছিল। অনেক সময় মিছিল, শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার আগে আমরা জানতাম যে আজ মিছিলে গুলি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবু এই ভেবে যোগ দিতাম যে এত লোকের মধ্যে গুলি আমার গায়ে লাগবে না। আর লাগলেও বড়জোর হাতে বা পায়ে লাগবে। অতএব, মিছিলে যেতে আপত্তি নেই। কিশোর ছাত্রদের এই বেপরোয়া ভাব যেকোনো শাসক গোষ্ঠীর জন্য আতঙ্কের ব্যাপার। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় মতিঝিলে আমার অফিসের জানালা দিয়ে দেখেছিলাম উদাম গায়ে নেচে নেচে যে ছোট ছোট মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দেওয়ার সাধ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছিল না। কার্যকরভাবে মিছিলের গতি রোধ করলে গুলি চালাতে হতো, যা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সেই পরিস্থিতিতে সম্ভব ছিল না। তারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল অথবা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বড় ধরনের দাবি আদায় করা যায়। সরকারকে বিপাকে ফেলা যায়। এর সঙ্গে আমজনতা যোগ হলে সরকারকে বিদায় নিতে হয় এমন নজিরও আছে। কিন্তু কিশোর ছাত্ররা পুরো ‘সিস্টেম’ বদলে দিয়ে রাতারাতি উন্নত, দক্ষ ও জনবান্ধব সিস্টেম চালু করতে পারবে—এমনটি আশা করা যায় না। একটি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা কোনো বিশেষ সেক্টরের ব্যবস্থার নিজস্ব Dynamics (পদ্ধতি-প্রক্রিয়া) রয়েছে। সেই Dynamics ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হয়ে পড়ে। নানা প্রকার কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বিরাজমান পদ্ধতি থেকে উল্লেখযোগ্য বৈষয়িক সুবিধা ভোগ করে। এদের মধ্যে একটি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। সেই নেটওয়ার্কে রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি নির্বাহী (আমলা), ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমের নির্বাহী বা কর্মী, পেশাজীবী, সুধীসমাজের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এঁদের যোগসাজশে যে রেওয়াজ ও পদ্ধতি গড়ে উঠে হাঁকডাক, ছোটাছুটি করে, ইলেকট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়ায় চমক (Stunt) সৃষ্টি করে, সেই পদ্ধতি-পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা যায় না। এর জন্য যে জ্ঞান, দক্ষতা, অবিচল নিষ্ঠা, ধৈর্য, কষ্টসহিষ্ণুতা, সৎ ও উদ্যোগী প্রয়োগের প্রয়োজন হয়, আমাদের দেশে সচরাচর তা পাওয়া যায় না। এর জন্য ধীশক্তির সঙ্গে যথাযথ প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয়। কিশোর-তরুণরা যা করেছে, তা নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ উপযোগী। তবে একে টেনে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি একটি দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে যে সাংগঠনিক শক্তি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার প্রয়োজন, তা জোগাড় করার জন্য ধৈর্যসহকারে আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এগোতে হবে। কিশোর-তরুণদের সাহস, ক্ষিপ্রতা ও উদ্যোগ, বয়স্কদের বুদ্ধি-পরামর্শ ও সরকারের সমর্থন (নিদেনপক্ষে সবুজ সংকেত) এ কাজটি যৌক্তিক পরিণতির পথে এগিয়ে নিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের চাবি সরকারের হাতে রক্ষিত থাকে। সরকার না চাইলে বড় একটা কিছু হয় না। কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের কুটিল নেটওয়ার্ক যথেষ্ট বিস্তৃত এবং শক্তিশালী। একে ভাঙতে হলে কিশোর-তরুণ, সু-অভিভাবক ও সুনাগরিকদের মজবুত প্রতিশক্তি (Countervailing force) হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। এই প্রতিশক্তি সরকারের ওপর ভারী চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। তখন হয়তো অর্থবহ কিছু টেকসই পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান