Tue. Jun 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খোলা বাজার ২৪, সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১৮ঃ  গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে ছিলাম। মাসব্যাপী হনলুলু ও মাওয়ি থাকার কারণে সেখানকার সড়কপথের শৃঙ্খলা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের অসহনীয় যানজট সেখানে নেই। নেই নিয়ম ভাঙার কোনো প্রবণতাও। কিন্তু পাবলিক পরিবহন হিসেবে সেখানে এসি বাসের গুরুত্ব দেখতে পাবেন। বড় বড় বাস বিভিন্ন রুটে সময় মেপে চলছে। চার ডলার দিয়ে একটি টিকিট নিয়ে সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সব রুটের বাসে আপনি নিশ্চিন্তে উঠতে পারবেন। শুধু মাওয়ি দ্বীপের সরকারি পরিবহনের হিসাবমতে, বাসে বছরে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ আরোহী হয়। নিরাপদ সড়ক বলতে যা বোঝায় তার সব ব্যবস্থাই সেখানে লক্ষ করা যায়। পথচারী পারাপার, হাঁটার পথ, সাইকেল চালানোর আলাদা লেন সবই আছে। আরো আছে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণমুক্ত সড়ক পরিবেশের নিশ্চয়তা। একই চিত্র জার্মানির বিভিন্ন শহরেরও। হাইডেলবার্গে সাইকেলনির্ভর ইউরোপীয়দের দেখে আপনার ভালোই লাগবে। বড় বড় রেলস্টেশনের বাইরে কয়েক হাজার সাইকেল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের যাত্রীরা সাইকেল রেখে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে, আবার ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে বাসায় পৌঁছাচ্ছে। আবার যদি ঘনবসতিপূর্ণ কলকাতা শহরের দিকে নজর দেন তাহলে দেখতে পাবেন, সেখানেও নিরাপদ সড়ক গড়ে উঠেছে। যানজট কমেছে, পথচারীরা চলাচলে ফুটপাত ব্যবহার করছে। ভোরের আলো ফোটার আগেও ট্যাক্সিগুলো চলাচলের সময় সিগন্যাল বাতি ঠিকই অনুসরণ করে চলে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যের সড়কগুলোও দেখার মতো, যা আপনাকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর সিটির বাইরের বিশাল মহাসড়কগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে। নিরাপদ সড়কের জন্য এই মহাসড়কের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আইন-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলার রীতি অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। তা ছাড়া শুধু সড়কপথ নয়, একটি উন্নত শহরের জন্য বিকল্প পরিবহনব্যবস্থাও জরুরি। বিশেষত থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া খালটির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। একই সঙ্গে সেখানে জলযান ও উড়াল রেলের সংযোগগুলো জনগণকে স্বস্তি দিয়েছে। তথ্যসূত্রমতে, বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ মানুুষের জন্য এক হাজার ১৩৩টি যানবাহন রয়েছে। চীনে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার যানবাহন। ভারতে প্রায় ১৩ হাজার, পাকিস্তানে পাঁচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ যাত্রী এবং ৮০ শতাংশ পণ্য মহাসড়কপথে পরিবহন করা হয়। সব মিলে জাতীয় নিরাপদ সড়কের কথা বলতে গেলে দৃৃষ্টান্ত দিয়ে আরো অনেক কথা বলা যায়। বিশেষত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়েও আমরা সড়কপথের বাস্তবতা চিত্রিত করতে পারি।

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বলে দেয় বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র শোচনীয়। এ দেশ সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বের মধ্যে ১৩তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৭ সালে এ দেশ ছিল দুর্ঘটনার দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে সপ্তম স্থানে। গবেষকরা ২০১৭ সালের হিসাব উল্লেখ করে লিখেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশ বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে যানবাহনের অত্যধিক গতি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও সড়কের কাঠামোগত দুর্বলতা। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে; নতুন নতুন রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করা হচ্ছে। টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজও চলছে।  

২.      

২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর দিনটিকে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছিল ২৪ বছর ধরে। ওই দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় আরো অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বলা যায়, মর্মান্তিক মৃত্যু ও তা থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য দিবসটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তবে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে; কিন্তু তাদের আন্দোলন ও দাবি উপস্থাপন সত্ত্বেও নিরাপদ সড়ক এখনো দুর্লভ হয়েই রয়েছে। অর্থাৎ পরিবহন খাতে দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য এখনো বন্ধ হয়নি। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০১৭ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাবধানে চালাব গাড়ি, নিরাপদে ফিরব বাড়ি’। দিবসটি পালিত হলেও ২০১৮ সালে স্কুলছাত্ররা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেনি। চলতি বছর (২০১৮) ‘সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধি ও করণীয়’ প্রতিপাদ্যের আলোকে দিবসটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হচ্ছে। কিন্তু নিরাপদ সড়কের বাস্তবতা এখনো সুদূরপরাহত। প্রতিদিনই সড়কের অব্যবস্থাপনায় হয়রানির শিকার হচ্ছি আমরা। যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, জীবনের আয়ুও হ্রাস পাচ্ছে।

৩.

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ২১ অক্টোবর বলেছিলেন, ‘সম্মিলিত উদ্যোগে দেশে নিরাপদ সড়ক সম্ভব।’ অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও পরিবহনসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করবে—এটাই তাঁর প্রত্যাশা। তাঁর মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ পুনর্গঠনে যুদ্ধবিধ্বস্ত সড়ক অবকাঠামো স্বল্প সময়ের মধ্যে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করে সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী মহাসড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ইউনাইটেড নেশন্স ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০১১-২০২০ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর অনুসমর্থনকারী হিসেবে গোল-৩.৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নাধীন আছে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ হবে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। এ জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’-এ বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার জন্য আমাদের করণীয় হতে হবে নিম্নরূপ।

প্রথমেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। একটানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে। ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলো রিকশামুক্ত করা জরুরি। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চালানো বন্ধ করতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে। মোটরসাইকেল, সাইকেল ও পথচারীদের জন্য আলাদা লেন থাকতে হবে। সড়কের বিকল্প পরিবহন হিসেবে রেল ও নৌযানের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। গাড়ির গতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত গাড়ির ড্রাইভার যেন মোবাইল ফোন ব্যবহার না করেন সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা থাকলে তারা অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকবে। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যত্রতত্র গাড়ি থামানোর অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এ জন্য দরকার ট্রাফিক পুলিশের কঠোর নজরদারি। যদিও গাড়ির বীমা বাধ্যতামূলক, তবে রেন্ট-এ-কারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। গাড়ি ভাড়া করার সময় যাত্রীদের বীমা বাধ্যতামূলক হলে দায়বদ্ধতা বাড়বে উভয় পক্ষের। জনগণ, সরকার ও পরিবহনসংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতাই আমাদের ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালনকে সার্থক করে তুলবে। 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ

তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়