খোলা বাজার ২৪,শনিবার,১০ নভেম্বর ২০১৮ঃ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ফাঁকি উদ্ঘাটনে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে একে একে বেরিয়ে আসছে বড় অঙ্কের ফাঁকি। আকস্মিক পরিদর্শনে নথিপত্র জব্দ করা এবং ভ্যাট অফিসে দাখিল করা কোম্পানির নথিপত্র পরীক্ষায় বড় অঙ্কের ফাঁকি ধরা পড়ছে। গত তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন ভ্যাট অফিস পরীক্ষা করে ২৪ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৮৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধের বেশি অঙ্কের ফাঁকির অভিযোগ। গ্রামীণফোনসহ চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে ফাঁকির অভিযোগ ১০৬ কোটি টাকা। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আরো ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র বিশদভাবে নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানেও আরো বড় অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বৃহৎ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ-ভ্যাট অফিস ইতোমধ্যে ফাঁকি উদ্ঘাটন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব অর্থ পরিশোধের জন্য প্রাথমিক দাবিনামা জারি করেছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত দাবিনামাও জারি করেছে। ইতোমধ্যে অন্তত সাতটি প্রতিষ্ঠান ফাঁকি স্বীকার করে ওই অর্থ পরিশোধ করেছে। মোবাইল ফোন কোম্পানি ছাড়াও সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর বড় অঙ্কের ফাঁকি ধরা পড়ছে। ফাঁকি উদ্ঘাটন হওয়ার তালিকায় আরো রয়েছে বীমা কোম্পানি, কোমল পানীয়, ব্যাংক, দুগ্ধজাত পণ্যের প্রতিষ্ঠান, ফার্মাসিউটিক্যালস, তারকা মানের হোটেল।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে ৫৩টি প্রতিষ্ঠানে চলমান অডিটেও বড় অঙ্কের ফাঁকি উদ্ঘাটন হতে পারে মনে করছে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট অফিস। কারিগরি, তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানে অভিজ্ঞ ও আইনগত বিষয়ে পারদর্শী এনবিআরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভ্যাট অফিস। বিশেষায়িত নিরীক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের আমদানির তথ্য, ব্যাংক হিসাব বিবরণী, ডিলারের সঙ্গে লেনদেনের তথ্য, কোন দরে বিক্রি হচ্ছে আর কোন দর ভ্যাট অফিসকে দেখানো হচ্ছে, কাঁচামাল কোথা থেকে আসছে কিংবা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হচ্ছে কিনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে এসব তথ্যের সঙ্গে ভ্যাট অফিসে প্রতি মাসে দাখিল হওয়া রিটার্নের তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে রক্ষিত কাগজপত্র পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া বড় কোম্পানির আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকি ধরতে সম্প্রতি গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক অভিযান শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৩টির মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানে সাড়ে সাত কোটি টাকার ওপরে ফাঁকি বের হয়েছে। এ অর্থ পরিশোধের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা জারি করা হয়েছে।
অবশ্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষার পর এখন ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ফাঁকির আলামতও সরিয়ে ফেলছে বলে অডিটের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, বড় ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে ভ্যাট প্রদান করছেন কিনা, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর বাইরে অতীতে ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক হিসাবপত্র দিয়েছে কিনা- তাও যাচাই করা হচ্ছে। এতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই অনিয়ম বেরিয়ে আসছে
এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের হিসাবে, এর আগে গত পাঁচ অর্থ বছরে মোট ৬১টি প্রতিষ্ঠানে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে ১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার দাবিনামা জারি করা হয়। আদায় হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থ বছরেই ২৯ প্রতিষ্ঠানে অডিটে ১ হাজার ৪২০ কোটি টাকার দাবিনামা জারি করা হয়। অবশ্য আদায় হয়েছে মাত্র ৪০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ১৫টি প্রতিষ্ঠান অডিট করে ২৪০ কোটি টাকা দাবিনামা জারির বিপরীতে আয় হয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ১০টি প্রতিষ্ঠান অডিট করে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা দাবিনামা জারি করা হয়। আলোচ্য সময়ে আদায় হয় এক কোটি টাকার কিছু বেশি। তবে তার আগের দুই অর্থ বছরে মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠানে অডিট করে প্রায় ১৫ কোটি টাকা দাবিনামা জারি করা হলেও কোনো অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়নি। এনবিআরের দাবির পর অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে এসব অর্থ আদায় আটকে রয়েছে।