খোলা বাজার ২৪,শুক্রবার,২৩ নভেম্বর ২০১৮ঃ ‘১৯৭০ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকার সময় তৎকালীন জাতীয় নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। নির্বাচন বিষয়ে সেটাই ছিল আমার একমাত্র অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতা দিনে দিনে ফুলে-পল্লবে পল্লবিত হয়েছে, একইসঙ্গে তাতে আছে কিছু কাঁটার আঘাত। আজ আপনাদের সঙ্গে তা শেয়ার করতে চাই।’
কথাগুলো নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের। বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একটি বিশেষ সভায় এসব কথা বলেন তিনি। সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক, স্বরাষ্ট্র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ও সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, উপমহাপরিদর্শক ও সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। কমিশনের পক্ষ থেকে ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) চার কমিশনার ও ইসি সচিব।
তাদের সবাইকে সামনে পেয়ে বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় জন্ম নেওয়া ‘কিছু কাঁটার আঘাত’ তুলে ধরতে ভুললেন না মাহবুব তালুকদার।
মাহবুব তালুকদারের লিখিত বক্তব্য থেকে জানা যায়, অনিয়মের কারণে বরিশাল সিটি নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি), কিন্তু তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৭৯ জন প্রিজাইডিং অফিসারের একটি স্বাক্ষরবিহীন তালিকা রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠান গাজীপুরের জেলা প্রশাসক। এই দুই নির্বাচনের এ রকম অন্ধকার দিক ওঠে আসে এই কমিশনারের আত্ম-বিশ্লেষণে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এই দুই সিটির ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্বরত কর্মকতাদের কাছে সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এই কমিশনার।
গাজীপুর ও বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে সভায় দেওয়া মাহবুব তালুকদার বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভায় লিখিত বক্তব্য রাখার খুব একটা রেওয়াজ নেই। কিন্তু আজ আমি আপনাদের সামনে ব্যতিক্রম হিসেবে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করছি।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমরা দুটো উল্লেখযোগ্য নির্বাচন শেষ করেছিলাম। একটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং অপরটি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই দুটো নির্বাচনে আমরা সুনামের সঙ্গে উতরে গেছি বলে অনুমান করতে পারি। কারণ এ দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়নি। বলতে দ্বিধা নেই, এই দুটি নির্বাচনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন জনমানসে একটি আস্থার স্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে।
পরবর্তী সময়ে খুলনা গাজীপুর বরিশাল রাজশাহী ও সিলেট যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। আমি খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে কোনো কথা বলব না। তবে যেহেতু আমি বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একক দায়িত্বে ছিলাম, সেহেতু এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমাকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে অনুরোধ জানান। ‘গাজীপর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ‘স্বরূপ সন্ধান’’ শিরোনামে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তাকে সমর্পণ করি। অজ্ঞাত কারণে সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে আত্ম-বিশ্লেষণের তাগিদেই আমি গাজীপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নয়, কারও দায়িত্ব পালন অবমূল্যায়ন করার জন্য নয়, বিষয়গুলো উপস্থাপনা করতে হচ্ছে, পূর্বের সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে এবং আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুরূপ সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেই পথ সুগম করতেই এই আলোচনা।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন
গাজীপুর নির্বাচনের বিষয়ে আমি তিনটি ঘটনার উল্লেখ করব। প্রথম ঘটনা হচ্ছে গাজীপুর জেলা প্রশাসক ১৭৯ জন প্রিজাইডিং অফিসারের একটি স্বাক্ষরবিহীন তালিকা রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠালে রিটার্নিং অফিসার তা গ্রহণে অসম্মতি জানান। পরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে একটি ফরোয়ার্ডিং পাঠানো হলেও তাতে কারও স্বাক্ষর নেই।
উপযুক্ত বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ইসি কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া গিয়েছে। প্রতিবেদনটিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম যেহেতু রিটার্নিং অফিসার করে থাকে বিধায় প্রতিবেদনটি পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে এতদৃসঙ্গে প্রেরণ করা হলো। (সংযুক্ত: আট ফর্দ)
উল্লেখ্য যে, স্বাক্ষরবিহীন তালিকাটিতে কোনো শিরোনাম নেই। ফরোয়ার্ডিংয়ে জেলা প্রশাসক অফিসের নিম্ন পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি পুলিশের কার্যক্রম সম্পর্কিত। রিটার্নিং অফিসার মৌখিকভাবে বলেছেন বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর কোনো অভিযোপত্র প্রেরণ করা হলে পুলিশ অফিস থেকে তা গ্রহণের স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হতো না। অনেক অনুরোধের পর চিঠি গ্রহণ করা হতো। বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীর পুলিশি হয়রানি, গণগ্রেফতার, ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এসব অভিযোগ সংবলিত পত্রের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। রিটার্নিং অফিসার প্রেরিত ১১টি অভিযোগপত্রের মধ্যে মাত্র চারটির উত্তর পাওয়া গেছে, যা অনেকটা দায়সারা গোছের। পুলিশ বাকি সাতটি অভিযোগের কোনো উত্তর প্রদান প্রয়োজন মনে করেনি।
তৃতীয় বিষয়টিও পুলিশকে নিয়েই। গাজীপুরে নির্বাচনের সময় ইউনিফরমধারী (পোশাকধারী) পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি দেয়নি। নির্বাচনের পরে দেখা যায়, তাদের অনেকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। গ্রেফতার না করলে তারা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন
এবার বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আসি। এই সিটি করপোরশনের নির্বাচনের দায়িত্বে এককভাবে আমি ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল বরিশালের। সকালে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বেশ ভালো ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্নমুখী অনিয়ম শুরু হয়। বেলা ১১টার মধ্যে আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে, এভাবে ভোট গ্রহণ চলতে পারে না। সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের আমি জানাই বরিশালের ভোট কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। একপর্যায়ে কমিশনারদের সবাই ভোট বন্ধ করার বিষয়ে একমত হলেও নির্বাচন বন্ধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কিনা এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে কি না ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে বিরত থাকি। ইতোমধ্যে ছয়জন মেয়রপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন এবং একজন প্রার্থীই প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে বিজয়ী হন।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পর্কে পরে নির্বাচন কমিশনের যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, তার সম্মুখে রিটার্নিং অফিসার যে বক্তব্য দেন তার কিয়দংশ (কিছু) তুলে ধরছি, ‘কোনো কোনো বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশ কর্তৃক অযাচিতভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আবার সরকারি দলের প্রার্থীদের আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় পুলিশকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, উল্টো বিরোধী প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।’
অন্যদিকে নির্বাচনের সার্বিক পর্যালোচনায় তদন্ত কমিটির বক্তব্য, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার এ বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় কোনো পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেননি। ভোটকেন্দ্রসহ নির্বাচনি এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজকু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রে ও ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রচুর বহিরাগতদের অবস্থান ছিল।’
ডকুমেন্টসহ টাইপ করা ৭১ পৃষ্ঠার মূল তদন্ত প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি দুটি স্থান মাত্র উদ্ধৃত করলাম।