Mon. Apr 21st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার ২৪,শুক্রবার,২৩ নভেম্বর ২০১৮ঃ (ফারুক আহমেদ কলকাতা থেকে) বিশেষ প্রতিবেদন: উদার আকাশ কেবল পত্রিকা নয়, আত্মমর্যাদার অভিজ্ঞন।উদার আকাশ কেবল স্লোগান নয়, সুস্থ সমাজ গড়ার অঙ্গীকার।উদার আকাশ দিচ্ছে ডাক, ঘরে ঘরে নবচেতনা পৌঁছে যাক। 

এই আহ্বান জানিয়েছে উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ। ১৭ বছর ধরে বহু লেখকদের আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করেছে উদার আকাশ ভাব ও ভাষা সমৃদ্ধ প্রগতিশীল সাহিত্য বিষয়ক গবেষণাধর্মী পত্রিকা। আগামী জানুয়ারিতে ১৮ বছরে পড়বে উদার আকাশ পত্রিকাটি। 

এবার একটা অন্যরকম বিশেষ সংখ্যা নিয়ে পাঠকদরবারে হাজির হচ্ছে উদার আকাশ।

ভারতে এই প্রথম কোনও সম্পাদক "ঈদ উৎসব ও মহিষাসুর স্মরণ সংখ্যা ১৪২৫" প্রকাশ করলেন এবং আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমালোচনা ও আলোচনার ঝড় তুলল উদার আকাশ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা।

"উদার আকাশ" পত্রিকার বিশেষ "ঈদ উৎসব ও মহিষাসুর স্মরণ সংখ্যা ১৪২৫" প্রকাশ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো ২৩ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার সন্ধ্যা ৫ টায়, কলকাতা প্রেস ক্লাবে। 

উদার আকাশ বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করলেন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. হুমায়ুন কবীর, কবি সুবোধ সরকার 'সাহিত্য অকাদেমির বাংলা উপদেষ্ঠামন্ডলীর আহ্বায়ক' ও রাজ্য 'কবিতা আকাদেমি’র চেয়ারম্যান, রাজ্যসভার সাংসদ ও 'পুবের কলম' পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরান, শিক্ষাবিদ আমজাদ হোসেন, প্রাক্তন আইপিএস অফিসার মোঃ নিজাম শামীম, পীরজাদা খোবায়েব আমিন, সমাজকর্মী মোঃ আবেদ আলি, আজাদ মহলদার, কঙ্কন কুমার গুঁড়ি, সমীর কুমার দাস, হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ নাবিলা খান, সাবির আহমেদ, স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী পলাশ চৌধুরী, মধুশ্রী হাতিয়াল সহ প্রত্যেক অতিথিকেই উদার আকাশ পত্রিকার পক্ষ থেকে "উদার আকাশ স্মারক সম্মাননা" প্রদান করা হয় এদিন।

উদার আকাশ পত্রিকার সমস্ত লেখকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সমবেতভাবে প্রকাশ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো এবং অভিনবত্বের ছাপ রাখতে পারল।

কবিতা পড়লেন কবি অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরোজ হোসেন, উপস্থিত ছিলেন কবি অয়ন চৌধুরী, মিজানুর রহমান রোহিত, ফিরোজ হোসেন ও তাজিমুর রহমান, আবৃত্তি শিল্পী ড. পিনাকী চট্টোপাধ্যায় সহ প্রত্যেককেই উদার আকাশ পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল অতিথিকে "উদার আকাশ স্মারক সম্মাননা" প্রদান করা হয়।

বহু বিশিষ্ট মানুষের উপস্থিতিতে "উদার আকাশ" পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামমের স্মরণে গজল পরিবেশন করবেন সঙ্গীতকার পলাশ চৌধুরী।

বিশ্বে শান্তি ফেরাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবন আদর্শ নিয়ে আলোচনা করলে ন বিশিষ্ট অতিথিরা।  

আলোচনা সকলকে মুগ্ধ করল।

"উদার আকাশ" পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ ও সহ সম্পাদক মৌসুম বিশ্বাস জানালেন, এই বিশেষ সংখ্যায় কলম ধরেছেন ভারত-বাংলাদেশের বহু লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের একটা বড় অংশ।

গল্প, অণুগল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক নিয়ে বিশেষ আলোকপাত, ভাষার উপর বিশেষ প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা সহ নানান ধরনের লেখা প্রকাশ করা হয়েছে এবারের সংখ্যায়।সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে সারফুদ্দিন আহমেদ-এর অনবদ্য প্রচ্ছদ যা সকল মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট লেখক ও কবি তরুণ মুখোপাধ্যায়।মহিষাসুরকে নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক গৌতম রায়।

বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখার সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছে উদার আকাশ।গৌতম রায় যে প্রবন্ধ লিখেছেন তা নিয়ে সাহিত্যানুরাগীদের মনে একটা ঝড় তুলেছে। 

প্রবন্ধটি হুবাহু উদার আকাশ পত্রিকার সৌজন্যে তুলে ধরা হলো। 

"মহিষমর্দিনী বনাম মহিষাসুর পূজা" গৌতম রায়–সমগ্র বাঙালি জাতি (কেউ-কেউ যাদের আজকাল ‘বিশ্ববঙ্গ’ বলে ডাকছেন)যখন দুর্গোত্সবে মেতেছে, রকমারি ‘থিম’-এর পুজোয় জমে উঠেছে মণ্ডপ-পরিক্রমা, তখন এই বঙ্গদেশেরই কিছু মানুষের কাছে এই হুল্লোড় বয়ে এনেছে মর্মান্তিক বিষাদের কৌম স্মৃতি। দেবী দুর্গার অসুরবধ কিংবা অশুভ শক্তিনাশের গল্পে তাঁরা মজে উঠতে পারছেন না। তাঁরা বরং শোক পালন করছেন— মহিষাসুরকে অন্যায়ভাবে চিত্রিত ও পরাভূত করার স্মৃতি তাঁদের বেদনায় আচ্ছন্ন করছে। 

মহিষাসুর তাঁদের কাছে হিন্দু পুরাণের খলনায়ক নন, বরং একজন বীর যোদ্ধা, যিনি অনার্য বিক্রমের প্রতীক, যাঁকে ছলচাতুরি করে আর্যরা হত্যা করে নিজেদের হৃত রাজ্য পুনর্দখল করে। দেব-দানবের কিংবা সুর-অসুরের যুদ্ধ তো আসলে ভারতভূমিতে আর্য বনাম অনার্যের ক্ষমতা-দখলেরই লড়াই। তাই প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর লোকেরা আজও মহিষাসুরকে তাঁদের আদি পিতৃপুরুষ ও কুলগুরু বলে গণ্য করেন এবং দুর্গার হাতে তাঁর নিধনে শোক উদযাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা ও ছত্তিশগড়ের সাঁওতালরা গত ১৪ বছর ধরে মহিষাসুরের মূর্তি বানিয়ে তাঁর পুজো করে আসছেন এই অকালবোধনের শারদীয় লগ্নেই। আর ‘অসুর’ পদবিধারী জনজাতির লোকেরা তো মহিষাসুরের পুজো করেনই।  প্রধানত লাতেহার, গুমলা, লোহারডাগা, পালামৌ, খুন্তি ও সিমডেগা জেলাতেই বসবাস করেন এই অসুররা।  সংখ্যায় আজ তাঁরা নগণ্য— ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মাত্রই ১০ হাজার ৭১২ জন।  কিন্তু তবু তাঁরা সুন্দরী গৌরবর্ণা দেবী দুর্গার চেয়ে কৃষ্ণবর্ণ দৈত্যরাজ মহিষাসুরকেই নিজেদের অধিকতর পূজ্য মনে করেন। 

পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র পূর্ব ভারতের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীও মহিষাসুরকে তাঁদের আদিপিতা রূপে মান্য করেন। পুরুলিয়া জেলার কাশীপুরে রীতিমত মূর্তি গড়ে মহিষাসুরের পুজোও হয়, সেই উপলক্ষে মেলা বসে।  সাঁওতালদের ছত্র-সংগঠন ভারত জাকত মাঝি মাড়োয়ার নেতা নিত্যানন্দ হেমব্রম বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম জনজাতির সংস্কৃতিকে পদানত করতে মহিষাসুরমর্দিনীর যে গল্প পুরাণে ফেঁদে রেখেছে, তার বিকল্প পাঠ বা বয়ানও রয়েছে, যা এ দেশের জনজাতিদের মধ্যে জনপ্রিয়।  সেই বিকল্প জনজাতীয় বয়ানে মহিষাসুর ছিলেন এক অপরাজেয় অনার্য যোদ্ধা, যিনি সম্প্রসারণশীল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে শুধু ঠেকিয়েই রাখেননি, তাকে পরাস্ত ও কোণঠাসা করে প্রায় দেশছাড়া করে দিয়েছিলেন।  মহিষাসুর বা তাঁর মতোই অন্যান্য অসুররাজের পরাক্রমের কাছে আর্য সভ্যতাভিমানীদের উপর্যুপরি পরাজয়ের ঐতিহাসিক বাস্তবতাই পুরাণে দেবতাদের বারংবার স্বর্গচ্যুত হওয়ার আখ্যানে প্রতিফলিত হয়েছে।  এঁদের মধ্যে মহিষাসুরই যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, কর্নাটকের মহীশূর রাজ্য তার জ্বলন্ত প্রমাণ।  চামুণ্ডি পাহাড়ের উপর মহিষাসুরের সেই মূর্তি পর্যটক মাত্রেই দেখেছেন।  তাঁর নাম অনুসারেই যে মহীশূর রাজ্যের নামকরণ হয়, তাতে সংশয় নেই। 

এই মহিষাসুরকে যখন কোনও ভাবেই সাহসে বা শৌর্যে দমন করা যাচ্ছে না, তখনই আর্য সভ্যতা ছলাকলার আশ্রয় নেয়।  

এক অপরূপ সুন্দরী আর্যকন্যাকে পাঠানো হয় তাঁকে প্রলুব্ধ করে ধ্বংস করতে। মহিষাসুর সেই ফাঁদে পা দেন। রূপমুগ্ধ তিনি দুর্গাকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন (যে-কথা হিন্দু পুরাণগুলিতেও উল্লেখিত রয়েছে)। পুরাণে অতঃপর দুর্গার তাচ্ছিল্যপূর্ণ প্রত্যাখ্যানের গল্প রয়েছে, যেখানে দুর্গা বলছেন, তাঁকে যুদ্ধে হারাতে পারলে তবেই তিনি মহিষাসুরের ঘরনি হবেন। কিন্তু প্রোটো-অস্ট্রাল জনজাতির বয়ানে ঘটনার বিবরণ ভিন্ন। সেখানে দুর্গা কোনও দেবী তো ননই, বরং এক পরমাসুন্দরী যৌনকর্মী, যাঁকে আর্যরা নিয়োগ করেছিল মহিষাসুরকে ফাঁদে ফেলতে। ছলাকলায় বশীভূত করে দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ধরে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেন, যা নবরাত্রির আড়ালে রয়ে গেছে। মহিষাসুরকে প্রচুর মদ্যপান করিয়ে, সম্ভবত বিবিধ আয়ুর্বেদিক ওষুধপত্র প্রয়োগ করেও, বিবশ ও শক্তিহীন করে ফেলার পর নবমীর দিন রাত্রিশেষে তাঁকে হত্যা করা হয়। অন্তত সাঁওতাল ও অসুর জনজাতির মানুষদের তেমনই বিশ্বাস। 

মহিষাসুরের হত্যার দিনটিকে তাই অনার্যরা, ইদানীং সচেতন দলিত-আদিবাসী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিও “মহিষাসুর শহিদ দিবস” হিসাবে উদযাপন করে থাকে।  এমনই একটি শহাদত উদযাপনের লিফলেট লোকসভায় তদানীন্তন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে পড়ে শুনিয়েছিলেন। সে জন্য তিনি অবশ্য আগাম ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন এমন হিন্দুত্ববিরোধী কোটেশন উচ্চারণ করার দায়ে।  এখানেই থেমে থাকেননি ইরানি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিষাসুর শহিদ দিবস পালনকারী দলিত শিক্ষার্থীদের তিনি “জাতীয়তা-বিরোধী” আখ্যাও দেন। জাতীয়তা, হিন্দু পুরাণের গালগল্প ও তার ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাখ্যা সব একাকার করে দেবার চেষ্টা হয়। 

ভারত যে বহু জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় ও ভাষাভাষীর দেশ, এ কথা আমরা প্রায়শই মনে রাখি না। বাঙালি জাতি, বিশেষত তার শিক্ষিত অংশও তাই কখনও মহিষাসুরমর্দিনীর পুরাণকল্পের হিন্দু ব্রাহ্মণ্য চৌহদ্দির বাইরে পা বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করেনি।  মহিষাসুরকে যাবতীয় তমসা, অন্ধকার, অশুভ. অকল্যাণ ও অমঙ্গলের শয়তানি রূপে চিত্রিত করে এসেছে। কুমোর-কারিগররা, এমনকী “আর্টের ঠাকুর” গড়া শিক্ষিত প্রতিমাশিল্পীরাও ব্রাহ্মণ্য হিন্দুত্বের পৌরাণিক ছকের বাইরে গিয়ে কখনও মহিষাসুরের মূর্তি গড়তে সচেষ্ট হননি। কখনও তাঁদের মনে হয়নি, হিন্দু বাঙালির এই অসংবেদী আধ্যাত্মিক বীক্ষা সাঁওতাল বা অসুর জনজাতির, বস্তুত সমগ্র অনার্য জনগোষ্ঠীর অর্থাত্ দলিত-অন্ত্যজ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংবেদনশীলতাকে নিয়মিত আঘাত করে চলেছে।  জনজাতিগুলি নিজেদের মতো করে তাঁদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভের কথা জানিয়েছে। কিন্তু আমরা, শিক্ষিত বিশ্ববঙ্গ, তা উপেক্ষা করেছি। আসলে গোটা জনজাতির, এ দেশের অনার্য ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতিকে হয় ধ্বংস করে দেওয়া নতুবা কৌশলে আত্মসাত্ করার ঐতিহাসিক আর্যায়ন বা সংস্কৃতায়নে আমরা তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালিরা তো গো-বলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের সমান শরিক! তা না হলে মহিষমর্দিনীর সমান্তরালে দুর্গামর্দক মহিষাসুর-এর পুজো না চালু হোক, বিকল্প বয়ান ও ভাষ্য তো বঙ্গীয় মনীষার কাছে এতদিনে প্রত্যাশিত ছিল।