খােলাবাজার২৪,রবিবার,০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ঃ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একটি ক্ষুদ্র অংশের নেতা আ স ম আবদুর রব হুমকি দিয়ে বৃহস্পতিবার বলেছেন, ১০ তারিখের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালানোর পথ পাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে হঠকারী রাজনীতির প্রবর্তন হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের হাত ধরে। একসময় তাঁরা বঙ্গবন্ধুর গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন। জাসদ সর্বনাশ করেছে অনেক প্রতিভাবান তরুণের। এখন জাসদ বহুধাবিভক্ত। আ স ম আবদুর রবের জাসদে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মশাল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জাসদ, এখন রবের জাসদ ধানের শীষ দিয়ে সম্ভবত তাদের ইতিহাসের সমাপ্তি টানছে। রাজনীতিতে হুমকি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে। ইদানীং ভারতে নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী নিয়মিত পরস্পরকে হুমকি দিচ্ছেন। কদিন আগে মোদি ঘোষণা করেছেন, তিনি রাহুল গান্ধীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দেবেন চা-ওয়ালার ক্ষমতা কতটুকু। মওলানা ভাসানী হুমকিতে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তিনি কোনো জনসভায় উপস্থিত হয়ে প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করতেন তাঁর শ্রোতাদের উদ্দেশে তা ছিল ‘খামোশ’। এর অর্থ হচ্ছে, ‘সকলে চুপ হয়ে যাও, নইলে সভা শুরু হবে না।’
চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্বাচনে বিজয় লাভের একটা কার্যকর পন্থা ছিল। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু। তিনি তাদের পাড়ায়-মহল্লায় গিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় জিজ্ঞেস করতেন—‘তোমরা কাকে ভোট দেবে?’ তাঁরা অনেকটা ভয়েই বলতেন, ‘চৌধুরী সাহেব আপনাকে ছাড়া আর কাকে দেব।’ উত্তরে ফজলুল কাদের চৌধুরী বলতেন, ‘ঠিক আছে। তোমরা ভোটকেন্দ্রে না এলেই বুঝব তোমরা আমাকে ভোট দিয়ে দিয়েছ।’ হুমকিটা বেশ প্রচ্ছন্ন। বাবার মতো ছেলে সাকা চৌধুরীও এই রকম হুমকি দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন পার করেছেন। বাবার হুমকি সত্তরের নির্বাচনে কাজ করেনি। সেবার এলাকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা দল বেঁধে নৌকা মার্কার প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে বিজয়ী করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর হুমকির কথা উঠলে তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা বলতেই হয়। তিনি ইয়াহিয়া খানকে হুমকি দিয়ে নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছিলেন। তিনি চলমান সংগ্রামের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রায়ই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হুমকি দিতেন। বাস্তবটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর হুমকি শুধু হুমকিতে সীমাবদ্ধ থাকত না। তিনি তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতেন।
২০১৩ সালের ৫ মে যখন হেফাজত ঢাকার মতিঝিল এলাকা দখল করল তখন রাতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাদের উদ্দেশে হুমকি দিয়ে বললেন, অবিলম্বে তারা মতিঝিল এলাকা ছেড়ে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর হুমকিতে কাজ না হওয়ায় সেই রাতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে মতিঝিল এলাকা খালি করা হয়েছিল।
এখন এই সময়ের দু-একটি হুমকির কথা বলি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি তথাকথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলো। উদ্দেশ্য তিনটি। এক. আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ফেলে দিতে হবে। দুই. বিলুপ্তির পথে বিএনপিকে পুনর্জীবন দান করতে হবে। তিন. স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে পুনর্বাসন করতে হবে এবং সবশেষ উদ্দেশ্য অর্থপাচার, গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানাতে হবে। বিএনপিসহ অনেক পরিত্যক্ত রাজনৈতিক দল তাঁর ঐক্যফ্রন্টের সদস্য। প্রথম সভা চট্টগ্রামে। ড. কামাল হোসেনের প্রথম হুমকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্দেশে। বললেন, নির্বাচনের পর এমন শাস্তি দেওয়া হবে, শেখ হাসিনা নাকি তা কল্পনাও করতে পারেন না। এককাঠি সরেষ তাঁর নতুন রাজনৈতিক সহকর্মী কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম, প্রথম বললেন, এবার ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে এমন নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগ কুড়িটির বেশি আসন পাবে না। এক দিন পর সংশোধনী দিয়ে বললেন, কুড়িটি নয়, উনিশটি আসন পাবে। তার আগে জোটের আরেক শরিক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না হুমকি দিয়ে বলেছেন, সামনের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ফেলে দিতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের আরেক নাম ‘শেখ হাসিনাকে ফেলে দিতে হবে পার্টি’। বেশ কিছুদিন আগে একবার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জের নাম বদলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে হুমকির ধরনও পাল্টাতে থাকবে। ধরে নিতে হবে এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সব কিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলে এসব হুমকিওয়ালাদের তখন হারিকেন দিয়ে খুঁজতেও হতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেকটা মিলিটারি কায়দায় হুমকি দেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর ডাকা পেট্রলবোমা সন্ত্রাস বাস্তবায়নে ব্যস্ত জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা। এই সময় তিনি একদিন তাঁর গুলশানের বাড়ি থেকে ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’ নামের গাড়ি মার্চের নেতৃত্ব দিতে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন। বাদ সাধল পুলিশ। কিছু মহিলা পুলিশও ছিল। তাদের তিনি ‘গোপালি’ বলে বেশ কর্কশ ভাষায় সম্বোধন করে হুঙ্কার ছাড়লেন—ক্ষমতায় গেলে গোপালগঞ্জের নামই বদলে দেবেন। বিএনপির মধ্যম সারির নেতা শামসুজ্জামান দুদু। গত ২ নভেম্বর এক টিভি টক শোতে হুঙ্কার দিলেন—৭ নভেম্বর থেকে দেশের শাসনভার ঐক্যফ্রন্টের হাতে চলে আসবে।
গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। খালেদা জিয়ার স্বঘোষিত উপদেষ্টা। শুক্রবার হুমকি দিলেন, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া আইনিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালাস পাবেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের মৌসুম শুরু হয়েছিল আলাপ-সংলাপের মধ্য দিয়ে। তা এখন প্রলাপে রূপ নিয়েছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘শীতকালে পাগলের সংখ্যা বাড়ে’। এবার দেখা যাচ্ছে শীত আসার অনেক আগে থেকে পাগলের সংখ্যা বাড়া শুরু হয়েছে।