খােলাবাজার২৪, রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ :১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান এর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়। মেজর জিয়াউর রহমান ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দ্বায়িত্ব পালন করেন, সশস্ত্র যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধকে বেগবান করার জন্য জেড ফোর্স এর নেতৃত্ব দেন। কৃষক-শ্রমিক-যুবক, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তথা আপামর জনসাধারণের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার লক্ষ্যই ছিল সবার সমান অধিকার এবং গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা। কেননা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান বিজয় লাভ করে যখন পাকিস্তানের শাসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা প্রদানে প্রবল অনীহা; এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই ছাড় দিবেন না পাকিস্তানের শাসক হতে। এমনি গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে অন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং দেশ স্বাধীনও হয়। স্বাধীনতার পর প্রথম শাসকের বাকশাল-একনায়কতন্ত্র বিলোপ করে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর আকস্মিক মৃত্যুর পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং স্বৈরাশাসন শুরু করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেশ স্বৈরাশাসকের কবলে পড়লে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর গণতান্ত্রিক ধারায় জনগণের ভোটে ক্ষমতার পালাবদল চলছিল। কিন্তু আওয়ামীলীগ জোট সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। এতে করে ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারী একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী জোট-বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বন্ধী করে সারাদেশ থেকে ঢাকাকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে। তারপর থেকে যেনো শুরু হয় অরাজকতা। জাতীয় থেকে স্থানীয় সকল প্রকারের নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বা নেতা-কর্মীদের, সমর্থকদের নিরাপত্তার অভাব, ভোটারদের ভোট দেওয়া থেকে অনীহা বা ভোট দেওয়া থেকে কৌশলে বিরত রাখা বা ভয়-ভীতি দেখিয়ে বা মামলা করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে ভোটারদের বা প্রার্থীদের দূরে রাখা। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার অভাব, গুম-খুন, অপহরণের ভয় তথা সব সময় মানুষের মাঝে আতংক বিরাজ করে। এমনি পরিবেশ চলতে চলতে এসে গেছে এই বিজয়ের মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিজয়ের মাসে এ নির্বাচন নিয়ে প্রজন্মের মাঝে আছে আকাঙ্খা বা চাওয়া পাওয়া।
এই বিজয় দিবসে প্রজন্মরা চায় সবার সমান অধিকার। তা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যে কোন ক্ষেত্রেই হোক। এই বিজয়ের মাসে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সাংবিধানিক নিয়ম ও আইন অনুযায়ী নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ থাকা বাঞ্চনীয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সব রাজনৈতিক দলের সে সুযোগ আছে বলে কি উপলব্ধি করা যায়…?
দেখা গেল মির্জ্জা ফখরুল সাহেবের গাড়ীবহরে হামলা হলো, অপরদিকে ওবায়দুল কাদের সাহেব পুলিশি প্রটোকল নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেন এবং সেই সাথে এও দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদের সাহেবের নির্বাচনী আসনে বিরোধী দলীয় বিএনপি প্রার্থী মওদুদ আহমেদ ঠিকভাবে প্রচারণা চালাতে পারেন না। পুলিশ ঘেড়াও করে রাখে এবং নির্বাচনী পথসভায় দফায় দফায় হামলা চালায়। তাহলে কি দেখা গেল নির্বাচনী পরিবেশ কি ঠিক থাকলো। সবার জন্য সমান সুযোগ রইল ? প্রজন্মরা এই যে পরিবেশ দেখছে তা চায় না; নতুন প্রজন্মরা সবার জন্য সমান সুযোগ চায়।
প্রজন্মরা দেখে আসতেছে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, সাবেক ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঠুনকো মামলায় বিচারিক কারসাজিতে কারাবন্দী আছেন এবং তার জামিন নিয়ে চলছিল সরকারের তাল-বাহানা আর বর্তমানে চলছে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে তাল-বাহানা। এক বেঞ্চ বলছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে আর আরেক বেঞ্চ বলছে অংশগ্রহণ করতে পারবে না অর্থাৎ বিভক্ত রায়। এভাবেই চলে যাচ্ছে দিন। ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। অপরদিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছিল প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ১৫ টি মামলা-যার মধ্যে একটি হত্যা মামলাসহ চাঁদাবাজির মামলাও ছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি সবগুলো মামলা তুলে নিলেন এবং বর্তমানে দেদারসে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রজন্মরা এখানেও স্পষ্ট বৈষম্যর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। প্রজন্মরা বিজয় দিবসে বৈষম্য চান না। চান সমান অধিকার, সবার জন্য সমান বিচার, বৈষম্যহীন ন্যায়-নীতি সমাজ।
বগুড়ায় বিএনপি প্রার্থী গোলাম মোঃ সিরাজের গাড়ী বহরে হামলা এবং ধূনটে যুবদল নেতার বাড়ীতে আগুন দিল আওয়ামীলীগ নেতারা। নরসিংদীতে ড. আব্দুল মঈন খানের নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামীলীগ নেতারা হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর আসনে, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের বিএনপি প্রার্থীর গাড়ীবহরে হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। ঢাকায় বিএনপি’র সাবেক ৩ কমিশনারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঢাকা-১২ আসনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা-৯ আসনে আফরোজা আব্বাসের নির্বাচনী প্রচারণায় পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে। এভাবে সারা দেশের কোথাও না কোথাও বিএনপি প্রার্থীদের ও নেতা-কর্মীদের উপর প্রচারণার সময় হামলা, ভাংচুর চালানো হয়। অথচ কখনো শোনা যায়নি বা দেখা যায়নি যে, কোথাও আওয়ামালীগের উপর কেউ হামলা বা ভাংচুর করেছে। বরং আওয়ামী নেতারা উল্টো বলছে বিএনপি’র প্রচারণায় কোন বাধা দেওয়া হচ্ছে না। সুনামগঞ্জ-২ আসনের নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী নেতা ও দিরাই পৌর মেয়র বলেছেন কেন্দ্র দখলে বিএনপি বাধা দিলে চোখ উপরে ফেলা হবে। ওবায়দুল কাদের সাহেব এক ভাষণে বলেছেন ‘ভাষণ দিয়ে লাভ নেই-অ্যাকশনে যেতে হবে’। প্রজন্মরা দেখতেছে এসবে নির্বাচন কমিশন যেনো বোবা, কানা,অন্ধ এবং শাসকের একান্ত অনুগ্রহ চার পায়ের পোষা প্রাণী। নির্বাচন কমিশন যেনো এক সাপ-যে সাপ অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে, যে সাপ খায় আর ঘুমায়। করে না-কো ফুঁসফাস, মারে না-কো ঢুঁসঢাস। যেনো এক নির্বোধ প্রাণী বা জন্তু কিন্তু নীতি কথার তর্জন-গর্জন শোনা যায়; কাজের বেলায় শুন্য। যেনো ‘শুন্য কলসি বাজে বেশী’ এর মতো অবস্থা। প্রজন্মরা এসব দেখছে আর ভাবছে স্বাধীনতার এতো বছর পর এই কি ছিল তাদের পাওনা ? যেখানে কোন সমতা নেই বরং স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব বিদ্যমান। একদল ক্ষমতার প্রটেকশন নিয়ে অবাধে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন আর অপরদল প্রচারণা চালাতে পারবেন না প্রজন্মরা তা কখনোই চান না না না না…….।
প্রজন্মরা দেখছে বিরোধী দলের এসব দমন-পীড়ন সংক্রান্ত খবর যেসব অনলাইন পোর্টাল ও লিংক ছাপিয়েছে সেগুলো সরকার বন্ধ করে দিয়েছে-যা ১৯৭৫ এর পত্রিকার কালো অধ্যায়ের কথা মনে করে দেয়। প্রজন্মরা এমন চান না। প্রজন্মরা মুক্ত সংবাদ পত্র চান ? যেখানে সরকারী দল ও বিরোধীদল উভয়ের যা সত্য, সৎ তাই প্রকাশ করা হবে।
প্রজন্মরা দেখছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার, প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রী থেকে অন্যান্য মন্ত্রী, এমপি ও আতি-পাতি নেতাদের মুখে নির্বাচন বিষয়ক শুধু ন্যায়-নীতির কথা কিন্তু কাজে তার প্রমান নেই, আবার ভয়-ভীতি দেখাতেও ছাড়েন না। প্রজন্মরা তাদের বক্তব্যের সাথে কাজের মিল নেই বলে মনে মনে বলছে-‘বেহায়া নির্বাচন কমিশন, বেপরোয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আর বেলজ্জা সরকার। প্রজন্মরা এমন চান না। তারা চান নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন কমিশন।
১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, রোজ শুক্রবার সকাল ১০ টার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে কি দেখা গেল ? প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনজীবী, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন এর উপর সরকারী মহলের সন্ত্রাসী হামলা অথচ প্রশাসন কিছুই করলো না। প্রজন্মরা এমন চান না। প্রজন্মরা চায় প্রশাসনের যথাযথ ব্যাবহার এবং সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সমান আচার-আচরণ ও ব্যবহার। কানা বকের মতো না যে এক চোখে দেখবে (সরকারকে); আর অন্য চোখে দেখবে না(বিরোধী দল বিএনপিকে)।
প্রজন্মরা গুম বা অপহরণ বা বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার চান না। অথচ বেছে বেছে শুধু বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, সুশীলরাই শুধু গুম বা অপহরণ বা বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হন। এই তো ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, রোজ শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সন্মুখ থেকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তুলে নিয়ে গেল জাসাস জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ সভাপতি (দপ্তরের দ্বায়িত্বে) জাহাঙ্গীর আলম রিপনকে। এরপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আর এই গুম বা অপহরণ বা বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার যারা করেন-তারা কোন এলিয়েন বাহিনী যে বেছে বেছে শুধু বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, সুশীলদেরই গুম বা অপহরণ বা বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করেন; আওয়ামী সরকারের কোন নেতা-কর্মীদের স্পর্শও করেন না। প্রজন্মরা এমনটি চান না-চান সবার সমান অধিকার ও সমান বিচার।
প্রজন্মরা আসলেই এমন বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, দমন-পীড়ন, নির্যাতন, গুম-অপহরণ চান না। আইন সবার জন্য সমান, আইনের সুবিচার, বৈষম্যহীন এক টেকশই উন্নয়ন সমাজ চান। প্রজন্মনা চায় সকল মানুষের নিরাপত্তা ও ভোটাধিকার, অবাধ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং ভোটের সঠিক হিসাব ও প্রকাশ। প্রজন্মরা চায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কেননা, এই দেশের ভবিষ্যৎ কা-ারীই হলো প্রজন্ম-ভবিষ্যৎ মালিকই হলো প্রজন্মসহ সকল জনসাধারণ।
মোঃ মিজানুর রহমান-লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।