খােলাবাজার২৪,সোমবার, ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ঃ এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় স্তম্ভিত বাংলাদেশ। জাতীয় নির্বাচনের পরেই রাত ১১টার দিকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলি ইউনিয়নের মধ্যমবাগ্যা গ্রামে সিএনজি অটোরিকশাচালকের স্ত্রী (৪০) গণধর্ষণের শিকার হন। স্বামী-সন্তানদের বেঁধে পিটিয়ে আহত করে তাদের সামনে গৃহবধূকে গণধর্ষণের এ ঘটনায় জাতি আজ মহালজ্জিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত। কারণ, এ ঘটনায় শুধু গৃহবধূই ধর্ষিত হননি, ধর্ষিত হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা।
জাতীয় নির্বাচনের নির্বাচনী চরিত্র নিয়ে যখন উল্লাস, উচ্ছ্বাস, সংযম, ক্ষোভ, ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে, তখনই বাংলাদেশ শিহরিত বিমর্ষ হয়ে পড়ে এ ঘটনাটি দেখে। দৃশ্যটি সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশের পতাকা বিরামহীন ক্রন্দনে বিলাপ করছে। সংবিধান, আইন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা ধিক্কার জানাচ্ছে এই কুৎসিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে-যা কুরে কুরে জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে এক গহীন অন্ধকূপে।
কারণ, এ ঘটনায় নির্যাতিত হয়েছে চারটি জিনিস; প্রথমত ভোট, কারণ ভোট দেওয়ার সাংবিধানিক স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি হিংস্র শাবকপাড়ার পশুরা; দ্বিতীয়ত নারী, যে সমাজের সর্বস্তরে অবহেলিত নিপীড়িত; তৃতীয়ত অটোরিকশাচালক শ্রমিক, যে সমাজের বিত্তবানদের চোখে গরিব ও দুর্বল; চতুর্থত অসহায় সন্তান, যাদের চোখের সামনে তাদের মাকে পৈশাচিক কায়দায় ধর্ষণ করে ১০-১২ জন কুলাঙ্গার মাস্তান। এ থেকে বোঝা যায় ঘটনাটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক শ্রেণিকাঠামো ও সামাজিক সম্পর্ক এই চারটি ক্ষেত্রের বেহালদশাকে চিত্রিত করেছে।
প্রথম ক্ষেত্রটির দিকে এখন সবার দৃষ্টি। কেননা রাজনৈতিক জীব হিসেবে মানুষ সুষম রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রত্যাশা করে। তা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভোটদানের অধিকার আমাদের সংবিধানস্বীকৃত নাগরিক অধিকার। এ অধিকার স্বাধীনতার মূল্যবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ স্বাধীনতার মূল্যবোধ। স্বাধীনতার মূল্যবোধ চর্চার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মত প্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা, ভোট প্রদানের স্বাধীনতা, জ্ঞানের নেতৃত্ব, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক সহযোগিতা, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারিপ্রতিষ্ঠানের জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতা, ন্যায়বিচার ও সর্বক্ষেত্রে সুষম যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয়। কিন্তু স্বাধীনতার মূল্যবোধকে এক নিমিষেই ধ্বংস করে দিতে পারে দুর্নীতির প্রবাহ, আইনের শাসনের অপপ্রয়োগ ও পেশিশক্তির বিস্তার।
ধর্ষক শ্রেণি হলো সেই শ্রেণি যে কিনা আইনের শাসনকে তোয়াক্কা না করে মানুষের স্বাধীনতাকে দমন পীড়ন ও হুমকি দিয়ে অবরুদ্ধ করে দেয়। এই শ্রেণি যদি সেই সুযোগ পেয়ে যায় তখনই তারা পশু প্রবৃত্তির ব্যবহারে হায়েনার মতো হামলে পড়ে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের স্বাধীনতাকে পদদলিত করে। এরই বাস্তবচিত্র আমরা দেখেছি সুবর্ণচরে।
কিন্তু কোনো ঘটনাই আর ঘটনা থাকে না। প্রতিটি ঘটনাই সংস্কৃতির বিস্তারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সুবর্ণচরের ঘটনাটি একই সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারের ফল ও ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণের এক অন্যতম কারণ হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত।
আরেকটি প্রশ্ন, নারী কেন শাবকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু? কারণ, একটি সমাজে নারীকে পুঁজিবাদী সমাজে মহনীয় পণ্যরূপে হাজির করা হলেও, সামন্তবাদী সমাজে নারী হলো একদিকে নিয়ন্ত্রণের বস্তু অন্যদিকে প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যস্থল। কেননা প্রতিশোধ প্রবণতা আর উচ্ছৃঙ্খল কামনার বিক্রিয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। এ বর্বরতার সুযোগ তখনই আসে যখন আইনের শাসন আর সামাজিক সম্পর্কের জায়গাটি অব্যবস্থাপনার মধ্যে অবস্থান করে।
অন্যদিকে শ্রমিক আক্রমণের কেন্দ্র হয়, এই ভেবে যে শ্রমিককে সমাজে দেখা হয় অর্থনৈতিক কাঠামোতে নিম্ন প্রজাতি হিসেবে। শ্রমিক মানে খেটে মরবে, কিন্তু সমাজে তারা মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না, তাদের থাকবে না কথা বলার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার। এর একটু ব্যত্যয় হলে, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সুবিধাভোগী প্রজাতি; উপর্যুক্ত ঘটনা যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা এক নির্মম সামাজিক বিভীষিকা দেখে বড় হয়, যা সামাজিক সম্পর্ককে হতাশা আর আধিপত্যের নিগড়ে নিক্ষেপ করে।
আমরা এরূপ রাজনৈতিক ও সামাজিক অব্যবস্থাপনা আর দেখতে চাই না। আমরা শুধু এ ১০-১২ জন অথর্ব কুলাঙ্গারের ফাঁসি চাই না। আমরা চাই বাংলাদেশের উজ্জ্বল চেহারা, যা স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সম্ভব নয়। সেই কারণে আমরা ফাঁসি চাই আধিপত্যবাদী অনৈতিক চর্চার ও সুবিধাভোগীদের লাম্পটের, ফাঁসি চাই শ্রেণি বৈষম্যের, ফাঁসি চাই সামাজিক অবিচারের। আর এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সরকার এবং সচেতন নাগরিকদের। তবে এদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর না করলে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ থেকে নিস্তার নেই। জাগ্রত হোক স্বাধীনতার মূল্যবোধ।
আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা