
অতীতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, নির্বাচন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই হওয়া উচিত এবং তা এ বছরেই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যদি ছাত্র সংসদের বিধান না থাকে তাহলে আইন পরিমার্জন করে সংশ্লিষ্ট বিধান সংযুক্ত করা হবে সমীচীন।
কোনো বিষয় নিয়মিত চর্চা না হলে তা মানুষের বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়। সে কারণে অনেকেই হয়তো ভুলেই গিয়েছেন যে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৯২৪ সালে ডাকসুর প্রথম কার্যক্রম শুরু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বপর্যন্ত প্রায় নিয়মিতই ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে।
এরপর থেকেই শুরু হয় নির্বাচন না-হওয়ার সংস্কৃতি। আটাশ বছর ধরে এ সংস্কৃতি বহমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ডাকসু নির্বাসিত এক নাম। একই অবস্থা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। ছাত্র সংসদের অবর্তমানে সারা দেশেই ছাত্র রাজনীতি হয়ে পড়েছে প্রাণহীন; নির্জীব হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার নেতৃত্ব বিকাশের সব লক্ষণ। অপ্রস্ফুটিত থেকে যাচ্ছে তাদের গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার কুঁড়িগুলো। হারিয়ে ফেলছে তারা সৃষ্টিশীল মতামত দেয়ার মানসিকতা।
আর রাজনীতি-বিমুখ প্রজন্ম তৈরি হওয়ার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জাতীয় নেতৃত্বে শূন্যতা। এমন পরিবেশে সুযোগ-সন্ধানী ব্যবসায়ীরা রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ সবাই জানেন, রাজনীতি যদি রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকে, তাহলে একটা দেশে কখনও পরিশীলিত রাজনীতির বিকাশ ঘটে না এবং সূত্রপাত হয় রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার। নিয়মিত ছাত্র-সংসদ নির্বাচন না হলে বিশ্বদ্যািলয়গুলোতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে পেশীশক্তি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে যেতে পারে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কব্জায়।
ফলে নির্ঘাত্ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষা-পরিবেশের উপর। ইতোমধ্যে পড়া শুরুও হয়েছে। কেন এমনটি হচ্ছে? ইতিহাস সাক্ষী, ডাকসুুর বদৌলতে জন্ম হয়েছে অনেক বাঘা বাঘা জাতীয় নেতার। ডাকসুতে যারা বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা জাতীয় সংকটের সময়ে অনেক অবদান রেখেছেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বই-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তারা তাদের অনবদ্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এই সেই ডাকসু যার নেতারা মুক্তিযুদ্ধে অচিন্তনীয় ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথমসারির রাজনীতিবিদদের বড় অংশই ডাকসুসহ তত্কালীন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদের তৈরি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে, গণতন্ত্রের চর্চা উত্সাহিতকরণে, গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতির প্রয়োজনে নেতৃত্বের হাল ধরার জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডাকসু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, যে কারণে ডাকসুকে বলা হতো দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। ্এতো মহত্ উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও কেন হারিয়ে যাচ্ছে সেই ডাকসু?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ১৯৬২-এর কালাকানুন বাতিল করে ১৯৭৩ সালে একটি অনবদ্য আইনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দিয়েছেন। ডাকসু সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোরই একটি অপরিহার্য অংশ। ডাকসু ছাড়া সিনেট অপূর্ণাঙ্গ। আটাশ বছর ধরে অপূর্ণাঙ্গ সিনেট দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। কারও তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
কেউ কেউ বলেন, গ্রীন সিগনাল নাই তাই নির্বাচন হয় না। আবার কেউ কেউ বলেন, নির্বাচন দিলেই লাশ পড়বে, সুতরাং দরকার কী ঝামেলায় যাওয়ার। অন্যরা প্রশাসনের অনীহার কথা বলেন। তারা বোঝাতে চান যে, উপাচার্য নির্বাচন দিলেই তো পারেন, দেন না কেন? কথার ধরন দেখে মনে হয়, উপাচার্য নির্বাচন দিলেই খুব সুন্দরভাবে নির্বাচন হয়ে যাবে, সবাই সুশান্ত হয়ে ভোট দিবে, সব ছাত্রছাত্রীর মুখে হাসি উপচে পড়বে আর দেশের জনগণ হাততালি দিয়ে বাহ্বা দিবে। এতো সরল সমীকরণ একেবারেই হাস্যকর।
এ-ই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে বর্তমান সময়ে নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য করণীয় কী? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির হালচাল, নেতানেত্রীদের দৃশ্যমান মনমানসিকতা, যে-কোনো সরকার ভালো কিছু করলেও বিরোধিতার খাতিরে তার ঘোর বিরোধিতা করার মনোবৃত্তি, ছাত্র নেতৃত্বের দৈন্যদশা, ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্রদের দাপুটেপনা, স্বাধীনতা-বিরোধীদের ছদ্মাবরণে বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশ ও জঙ্গিপনায় উসকানিদান ইত্যাদি সমসাময়িক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এখানে কয়েকটা সুপারিশ তুলে ধরছি।
নির্বাচনের পূর্বে: ১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার, ১৯৭৩ অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচন নির্ভর করে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিধায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিংবা অন্য কোনো সরকারি প্রশাসন-যন্ত্রের কিছুই করার নেই। সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হলে নির্বাচন হতে বাধ্য। তাই প্রথম পদক্ষেপ আসতে হবে সিন্ডিকেট থেকে। বর্তমান সিন্ডিকেট নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে সে রকম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিধায় উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত দিয়েছেন।
২) নির্বাচনের পূর্বে ক্যাম্পাসে সকল ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীদের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। তবে এটি সহজ বিষয় নয়। বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পজিটিভ ভূমিকা রাখা অপরিহার্য।
৩) শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবন্ধিত ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৪) সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের জিহ্বা সংযতকরণ অপরিহার্য।
৫) ক্যাম্পাসের পরিবেশ ছাত্র রাজনীতি-চর্চার উপযোগী করার লক্ষ্যে প্রশাসনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। সংগঠনগুলো ক্লাস-কক্ষ থেকে দূরের কোনো উন্মুক্ত স্থানে সভা করবে। কাউকে জোর করে কোনো সভায় বা মিছিলে নেওয়ার গণতন্ত্রবিরোধী বদচর্চাটি পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
৬) ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে অছাত্র বিতাড়ন ও ছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ কাজটি করবে কারা? করবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো।
৭) ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতৈক্য থাকতে হবে। নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, সবাইকে ফল মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
৮) নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই প্রত্যেকটি আবাসিক হলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
(৯) ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে নির্বাচনের আগে-পরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজিক নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে।
১০) ক্যাম্পাসে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন নিষিদ্ধ থাকবে; উন্মুক্ত মাঠে ’জনসভা’ করে প্রার্থী পরিচিতির কাজ সারতে হবে।
১১) সর্বক্ষণ ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
১২) সর্বোপরি, নির্বাচন প্রাক্কালে শিক্ষক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে; কোনো শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে বা দলবদ্ধভাবে কোনো ছাত্র সংগঠনকে প্রভাবিত করবে না মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
নির্বাচনের দিন:
১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন এলাকায় বেশির ভাগ ছাত্র-হল কেন্দ্রীভূত এবং এ কারণে এলাকাটি স্পর্শকাতরও বটে। তাই ক্যাম্পাসের এ এলাকায় প্রবেশপথ সীমিত রাখা আবশ্যক। নির্বাচনের দিন নির্দিষ্ট কয়েকটি গেট খোলা রাখতে হবে, যেগুলোতে সার্বক্ষণিক মানব-পাহারার পাশাপাশি ডিজিটাল পাহারাও থাকবে।
২) ব্যালটবাক্স টিএসসিতে একত্র করে ভোট গণনা করতে হবে, কড়া পাহারায়। নিয়োজিত এজেন্ট আর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ ভোট গণনার স্থানে থাকতে পারবেন না। এজেন্টদের মোবাইল ফোন বহন নিষিদ্ধ হতে হবে।
৩) ভোটের ফল প্রকাশ করতে হবে দিনের বেলায়। এদিন কয়েক স্তরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪) ফল প্রকাশের পর সকল প্রকার মিছিল নিষিদ্ধ থাকবে।
নির্বাচনের পরে: অছাত্রদের/বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে আগমন বা অবস্থান কমপক্ষে দশদিনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। দেখা যায়, সবসময় অছাত্র আর বহিরাগতরাই ঘরের বিভীষণদের সাথে মিলেমিশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায়। এছাড়াও, আনন্দ মিছিল বা প্রতিবাদ মিছিল বের করার অনুমতি দেয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন।
পরিশেষে বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্যান্য সব নির্বাচনই হচ্ছে। তাহলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে পারবে না কেন?
গণতন্ত্রের সূতিকাগার নামে পরিচিত এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সব সময়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে—পাকিস্তানি শোষক-শাসক, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক, স্বৈরাচারী শাসক এবং সর্বশেষে লুণ্ঠনকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে। সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন ইতিহাসের পাতায় স্থান নিবে?
এ ঐতিহ্য নষ্ট করা যাবে না। ডাকসু ছাত্র-নেতৃত্ব বিকাশের সফল কারখানা, সংস্কৃতি চর্চার বাতিঘর, স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকার রূপকার, ফলপ্রসূ ইতিবাচক আন্দোলনের সূতিকাগার আর স্মৃতিবিজড়িত অনেক গৌরবময় ঘটনার সাক্ষী। পদদলনের হাত থেকে একে রক্ষা করতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতীতের সোনালি গৌরব।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়