খােলাবাজার ২৪, শনিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ঃ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, আসুন তার বদলে সীমাহিন সহযোগিতা, সমঝোতা আর সবার জন্য যা ভালো তা নিয়ে এক হই। দশকের পর দশক যে রাজনৈতিক অচলাবস্থাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু একতার মাধ্যমেই ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব।
আক্রমণাত্মক বক্তৃতা, বিবৃতি, টুইটের বাইরে গিয়ে স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে এক অসাধারণ বক্তব্য দিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার বক্তব্য জুড়ে ছিলো ঐক্য আর সংহতি সুরক্ষার সুর। ভিন্ন এক ট্রাম্পকে খোজে পেলো আমেরিকাবাসী।
সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ ইস্যুতে দেশটির ইতিহাসের দীর্ঘদিনের শাটডাউন চলার পর মঙ্গলবার রাতের এই ভাষণটি ছিলো খুবি গুরুত্বপূর্ণ। কী বলবেন ট্রাম্প, তা নিয়ে কানা-ঘুষা ছিলো সব শিবিরেই। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রেসিডেন্ট আহবান জানালেন ঐক্য, সহযোগিতা আর সমঝোতার। ভালোবাসার সেতু বন্ধনে মিলিত হবার আহবান জানালেন ডেমোক্রেট, রিপাবলিকানসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে।
মন থেকে বিভক্তি দূর করার আহবান জানিয়ে কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমরা এক হলেই দূর হয়ে যাবে পুরনো সব ভেদাভেদ আর কষ্ট। আমরাই পারি নতুন করে মিত্রতা শুরু করতে।”
তিনি বলেন, “আমাদের যেকোনো একটি বিষয়কে অবশ্যই বেছে নিতে হবে- অচলাবস্থা কিংবা মহানুভবতা, উন্নয়ন বা প্রতিরোধ, সুদূর কর্মপরিকল্পনা কিংবা প্রতিহিংসা এবং অবিশ্বাস্য উন্নতি কিংবা অনিঃশেষ ধ্বংস। আমি আপনাদের আহবান জানাবো মহানুভবতাকে বেছে নিন।”
ট্রাম্প তাঁর এই বক্তব্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু নিয়েও কথা বলেন। বক্তব্যে উঠে আসে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, উত্তর কোরিয়া এবং আফগানিস্থানের সংকট মোকাবিলায় চলমান সংলাপসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যাদুকরি একটা পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। তবে আমরা যদি বোকার মতো কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি, কিংবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর ভূয়া তদন্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ি তাহলে সেটা থেমে যাবে।”
আগামী ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে ভিয়েতনামে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকটি তোলে ধরে ট্রাম্প বলেন, “আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট না হতাম তাহলে হয়তো এখন দেখতে পেতেন একটা বড় রকমের যুদ্ধ চলছে দেশটির সঙ্গে।”
“বিষয়টি নিয়ে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। তবে কিমের সঙ্গে আমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা খুবি ভালো অবস্থানে আছে।”
আফগান সংকট প্রসঙ্গে ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বলেন, “আফগান সংকটের অবসানে তালেবানদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন।”
“আমরা অন্তত এমন একটা সময়ে অবস্থান করছি যেখানে শুধু শান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি বলেন, দৃশ্যত সিরিয়া এবং ইরাক একটা সময় রক্তখেকো ইসলামিক স্টেট গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো। এখন তারা এথেকে মুক্ত হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, “সিরিয়ায় আমাদের সাহসী যেসব যুদ্ধারা রয়েছে তাদের দেশের মাটিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর এটা উপযুক্ত সময়।”
ট্রাম্প বলেন, প্রায় দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে চলা যুদ্ধে ৭,০০০ যুক্তরাষ্ট্রের সেনা নিহত হয়েছে। খরচ হয়েছে সাত ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশী।
তিনি বলেন, “ভালো কোনো জাতি এরকম লাগামহীন যুদ্ধে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে পারেনা।”
ট্রাম্পের এই স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে সাদা পোশাক পরে জমায়েত হয়েছিলেন ডেমোক্রেট এর মহিলা আইনপ্রণেতা সদস্যবৃন্দ। দেশটিতে নারীদের ভোটাধিকারের ১০০ বছর পূর্তি উদযাপন করতেই তারা এ পোশাকে সজ্জিত হন।
রিপাবলিকানরা যখন ট্রাম্পকে বাহবা দিতে উল্লসিত দেখা যাচ্ছিলো ঠিক তখনি পাশে অনেকটা গুরুগম্ভীর মেজাজে ছিলেন ডেমোক্রেটরা। তবে প্রেসিডেন্টের ঐক্যর বার্তায় মোহমুগ্ধ হয়েছেন তারাও। যার মুন্সিয়ানা ট্রাম্প তাঁর ভাষণে দেখিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট যখনি বললেন, “যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনে অতীতে অনেক নারীরা যুক্ত হয়েছেন। তবে বর্তমান সময়ে কংগ্রেসে সে অবস্থানটা যেকোনো সময়ের চাইতে বেশী।” ঠিক তখনি দাঁড়িয়ে যান ডেমোক্রেট নারী সদস্যরা, বাহবা দিয়ে জোর করতালি আর উল্লাসের মাধ্যমে স্বাগত জানান প্রেসিডেন্টকে।
তখন ট্রাম্পকেও বলতে শোনা যায়, “এটা অসাধারণ। সত্যিকার অর্থে বড় একটি বিষয়।”
প্রেসিডেন্টের ভাষণ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ডেমোক্রেট স্টেকি আব্রাম। তিনি বলেন, “শাট ডাউন এর নকশাটা ছিলো ট্রাম্পের নিজের বানানো। আর এ সিদ্ধান্তটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।” আব্রাম বলেন, ট্রাম্পের বিষয়ে তিনি হতাশ হলেও প্রেসিডেন্ট সামনে এগিয়ে যাবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন।
প্রেসিডেন্টের ভাষণে সবার অন্য যে বিষয়টিতে নজর ছিলো সেটা ছিলো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ। শ্রোতাদের উদ্দেশ্য ট্রাম্প বলেন, “অবৈধ অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কর্মঠ নাগরিকদেরকে তার দায়ভার নিতে হচ্ছে।”
অবৈধ অভিবাসীকে একটি “আসন্ন জাতীয় সমস্যা” অভিহিত করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে তাঁর আহবান পুন:ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, “এ কক্ষে যারা উপস্থিত আছেন অতীতে তারা সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু কার্যত কোনো দেয়াল হয়নি। আমি সেটা নির্মাণ করবো।”
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সম্ভাবনা দ্বার উন্মুক্ত মন্তব্য করে ট্রাম্প বলেন, “আমেরিকার রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে, যাদের সাহস আছে তাদের উচিত সে সুযোগটা লুফে নেওয়া। জয় বিষয়টা একটি দলের নয়, দেশের।”
তিনি বলেন, “বিশ শতকে এসে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিচ্ছে, বৈজ্ঞানিক নতুনত্ব এনেছে এবং মধ্যম শ্রেণীর জীবন যাত্রার মান বদল করেছে-যেটা পুরো বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে।যুক্তরাষ্ট্রের এই সুমহান অগ্রযাত্রায় এখন আমাদের দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। একুশ শতকে আমরা জীবন যাত্রার জন্য নতুন সূচনা করবো।”
ইউএস ক্যাপিটল হিলে দেয়া প্রেসিডেন্টের স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণটি খুবি তাৎপর্যপূর্ণ। বছরের শুরুতে প্রথা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিয়ে থাকেন। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, ক্যাবিনেট সদস্য, বাহিনী প্রধান ও বিশিষ্ট নাগরিকদের স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে আমন্ত্রণ জানান স্পিকার। জানুয়ারিতে ভাষণ দেয়ার জন্য নির্ধারিত থাকলেও শার্টডাউনের কারণে প্রেসিডেন্টকে হাউসে আমন্ত্রণ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন স্পিকার ও ডেমোক্রেট নেত্রী ন্যান্সি পিলোসি। ফলে আটকে যায় স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে ট্রাম্পের ভাষণ দেয়া। এ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে চলে চিঠি চালাচালি। অবশেষে দলীয় স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে ডেমোক্রেট অধ্যুষিত কংগ্রেস ও রিপাবলিকান সংখ্যা গরিষ্ঠ সিনেট কান পেতে শুনলো আলোচিত সমালোচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গুরুগম্ভীর ভাষণ।