Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

প্রধানমন্ত্রিত্ব আর নয়, ডয়চে ভেলেকে শেখ হাসিনা

খােলাবাজার ২৪,শুক্রবার,১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তিনি তরুণদের সুযোগ করে দিতে চান। এজন্য চান বর্তমান ও টানা তৃতীয় মেয়াদটিই যেন হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ মেয়াদ।

জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা একথা জানান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল ও এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ।

এক মাস আগেই চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দল আওয়ামী লীগ ও এর জোটের দলগুলো মিলে এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯৬ শতাংশ আসন জিতেছে।

টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেবার পর প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা এটা নিশ্চিত করেছেন, পরবর্তী মেয়াদে আর প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য চেষ্টা করতে চান না তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা আমার তৃতীয় মেয়াদ। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী হয়েছি (১৯৯৬-২০০১)। সব মিলিয়ে চতুর্থবার। আমি আর চাই না। একটা সময়ে এসে সবারই বিরতি নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেন তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেয়া যেতে পেরে।’

উন্নয়নের এক দশক
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গত এক দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বছরে গড়ে ৬ থেকে ৭ ভাগ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাণিজ্য বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে।

এই উন্নয়নের পরও বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, এখনো বাংলাদেশের প্রতি চারজনে একজন দরিদ্র। শেখ হাসিনা তার সম্ভাব্য শেষ মেয়াদে এই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইকেই অগ্রাধিকার দিতে চান।

তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান— এসব মৌলিক চাহিদা। প্রত্যেক মানুষই তার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চায়। আমাদের সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।’

উন্নয়ন বনাম বাকস্বাধীনতা
তবে, এই উন্নয়ন দিয়ে সেসব সমালোচকের মুখ বন্ধ করতে পারেননি শেখ হাসিনা, যাদের অভিযোগ— তিনি বা তার সরকার বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন এবং মুক্তচিন্তা ও মুক্তচিন্তকদের ওপর আঘাত থামাতে খুব বেশি কিছু করতে পারেননি।

কিন্তু, শেখ হাসিনা তা অস্বীকার করে বলেন, ‘মুক্ত চিন্তাকে শতভাগ সমর্থন করেন তিনি। সমালোচনাও তাই স্বাভাবিক।’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি, ‘যত কাজ করবেন, তত সমালোচনা শুনবেন। আপনি আমার দেশের মানুষকে প্রশ্ন করুন, তারা সন্তুষ্ট কিনা; তাদের যা যা প্রয়োজন, সব পাচ্ছে কিনা, কিংবা আমি সব দিতে পারছি কিনা।’

শেখ হাসিনা তার আওয়ামী লীগ বিরোধীদের জন্য রাজনীতির মাঠ সঙ্কুচিত করে রেখেছেন এবং এক দলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছেন— এমন অভিযোগও আছে জোরালোভাবে। কিন্তু, তা মানতে রাজি নন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটের মাধ্যমেই তো ক্ষমতায় আসা, সেটা একদলীয় হয় কী করে? আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ২০০৮-এ যে নির্বাচন হয়েছিল, সে নির্বাচনেও ৮৪ ভাগ (আসলে ৮৬.৩৪%) ভোট পড়েছিল। এবার তো ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট পেয়েছিল মাত্র ২৮টি আসন। এবার ইলেকশনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৬০টি সিট (৩০০টির মধ্যে)। বাকি সব অন্য দলগুলো পেয়েছে। সেখানে দল তো আছেই।’

বিরোধী দলকে দুর্বল মনে করেন শেখ হাসিনা, ‘এখন কোনো দল যদি তাদের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে না যেতে পারে, জনগণের বিশ্বাস, আস্থা অর্জন করতে না পারে, আর যদি ভোট না পায়, সে দায়-দায়িত্ব কার? সে তো ওই দলগুলোর দুর্বলতা।’

মৌলবাদের উত্থান ও নারী অধিকার
মৌলবাদীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নিবিড় সম্পর্ক আছে বলেও সমালোচনা আছে। বাংলাদেশের ‘উদারপন্থীরা’ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের সমালোচনা করেন।

তাদের অভিযোগ, এই গোষ্ঠী মৌলবাদী ও তারা নারীর বিকাশের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এই গোষ্ঠীর নেতা আল্লামা শাহ আহমেদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠানোর জন্য সমর্থকদের ওয়াদা করিয়েছেন।

তার এই বক্তব্যের দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, ‘আমি বলেছি, এখানে বাকস্বাধীনতা আছে। তাই যে কেউ যে কোনো কিছুই বলতে পারেন।’

নারীর বিকাশে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষা পুরোপুরি অবৈতনিক করে দিয়েছি। তাদের বৃত্তিও দিচ্ছি।’

মুজিব-কন্যা বলেন, তার নীতি নারী শিক্ষার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চিন্তাও বদলে দিয়েছে।

‘আগে বাবা-মায়েরা চিন্তা করতেন যে, মেয়েকে পড়িয়ে লাভ কী, সে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। এখন সেভাবে চিন্তা করেন না তারা। এখন ভাবেন যে, মেয়েকে শিক্ষিত করা উচিত যেন সে নিজে উপার্জন করতে পারে। এরপর সে বিয়ে করবে। খুব ধীরে ধীরে আমরা পরিবর্তন আনছি। বাল্যবিবাহ এখন অনেক কমে গেছে।’ যোগ করেন তিনি।

যে লক্ষ্য অর্জনে শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন, তাতে কি মৌলবাদীরা বাধা হবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন প্রশ্নে অবশ্যই না। আমি যা করেছি, তা করেছি এবং এটা চলবে।’

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ
জীবনমান উন্নয়ন এবং উদারপন্থী ও মৌলবাদীদের মাঝখানে একটি রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা ছাড়াও শেখ হাসিনার সরকারকে নতুন করে সাত লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘জঙ্গিবাদের’ বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের বলি হয়ে এরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে কক্সবাজারের দু’টি ক্যাম্পে বেশিরভাগই খুব মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই মানুষের স্রোত এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে। এদের অনেকেই স্থানীয়দের কাজ, থাকার জায়গা ও ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার শিশু-কিশোর-তরুণ যারা বেড়ে উঠছে, তাদের জন্য মধ্যবর্তী বিকল্প উপায় ভাবার চেষ্টা করছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা একটা দ্বীপ বেছে নিয়েছি। সেখানে আমরা বাঁধ দিয়েছি। সাইক্লোন শেল্টার ও ঘরবাড়ি তৈরি করেছি। আমরা তাদের সেখানে নিয়ে যেতে চাই এবং কাজ দিতে চাই। তাহলে তরুণ ও নারীরা অর্থ উপার্জন করতে পারবে।’

তবে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়াকে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বলে মনে করেন শেখ হাসিনা, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই এই দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে যেতে চায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভূমিকা রাখতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না। আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তিও হয়েছে যে, তারা ফেরত নিয়ে যাবে। চীন ও ভারতের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যে পাঁচটি দেশের বর্ডার আছে, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও লাওস, আমরা সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি যে, কীভাবে এই সমস্যা সমাধানে তাদের কাজ করা উচিত।’

শেখ হাসিনা যোগ করেন, ‘এটাই চাই যে, তারা মিয়ানমারকে এ কথাটি বুঝাক যে, এরা যখন মিয়ানমারে চলে যাবে, তখন তাদের যা যা সাহায্য দরকার, থাকার বাড়িঘর, তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা, এখানে যা যা দিচ্ছে, তা ওখানেই দেবে এবং তাদের একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তারা করবে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।’