খােলাবাজার ২৪,মঙ্গলবার,১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ঃ পটুয়াখালী সদর উপজেলার সাবিত্রী রানি মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর হাজীখালী গ্রামের বাসিন্দা। গতবছর স্থানীয় দুই যুবক বাড়িতে এসে ত্রাণ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যায়। কিছুদিন পর আবার ফেরতও দিয়ে যায়।
গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিন মাদারবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে সাবিত্রী দেখেন, ওই কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় তার নাম নেই। অথচ আগে তিনি এই কেন্দ্রেই ভোট দিয়েছেন। তার স্বামী কালুচন্দ্র ধুপী একই কেন্দ্রের ভোটার।
পরে খোঁজ নিয়ে সাবিত্রী জানতে পারেন, তিনি এখন পটুয়াখালী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ আরামবাগ শাহাপাড়া এলাকার ভোটার।
“অথচ আমি শাহাপাড়ায় কোনো দিন যাইনি। আমি গ্রামে থাকি, পৌরসভার শাহাপাড়া আমি চিনিও না। তাহলে আমার ভোট শহরে গেল কেমন করে?”
ত্রিশোর্ধ সাবিত্রী রানির মত পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর, আউলিয়াপুর, মাদারবুনিয়া, লাউকাঠী ও মৌকরণ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটার নিজেদের অজান্তেই পৌর শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটার হয়ে গেছেন।
ঠিকানা পরিবর্তন বা মাইগ্রেশনের এই ঘটনাগুলো ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে ঘটেছে বলে সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খালিদ বিন রউফের ভাষ্য।
কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেছেন, তার এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ড থেকে সহস্রাধিক ভোটারের নাম পৌরসভার তালিকায় চলে গেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তার সন্দেহ, এর সঙ্গে পৌর নির্বাচনের যোগ আছে।
নির্বাচন কমিশন ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন রেখে পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও সীমানা সংক্রান্ত এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোট স্থগিত করে দেয়।
ওই নির্বাচনে ‘অনৈতিকভাবে সুবিধা নিতে’ প্রার্থীদের কেউ সুকৌশলে গ্রামের ভোটারদের নাম শহরের তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে আব্দুস সালামের ধারণা।
পেছনে কে?
এ বিষয়ে ধারণা পেতে সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রামের দুঃস্থ নারীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ত্রাণের জন্য নাম লেখানোর কথা বলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কিন্তু ভোটার এলাকা বদলে দেওয়ার কথা তাদের জানানো হয়নি। কাগজে কলমে ভোটার এলাকা বদলে যাওয়ায় এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বয়স্ক ভাতা, দুঃস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডিসহ অন্য কোনো সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই ভুক্তিভোগীদের সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় রিয়াজ উদ্দিন মামুন, কবির ফকির ও বেলাল ফকিরসহ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, যারা ত্রাণের কথা বলে ভোটারদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যাওয়ার কাজটি করেছেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামুন আউলিয়াপুর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামের নাসির চৌকিদারের ছেলে। আর কবির ও বেলাল দুই ভাই। তারা মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের উত্তর হাজীখালী এলাকার মো. মজিদ ফকিরের ছেলে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হক রেজা জানান, মামুন এক সময় ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর কবির ও বেলাল জড়িত ছিলেন রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে।
স্থানীয়রা বলছেন, ওই তিনজনই মেসার্স মহিউদ্দিন আহমেদ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মহিউদ্দিন আহমেদ পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদের একজন প্রার্থী। সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নে তার গ্রামের বাড়ি।
মহিউদ্দিন আগে পৌর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে থাকলেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় সম্প্রতি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তারিকুজ্জামান মনি জানান।
২০১১ সাল থেকে এ পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শফিকুল ইসলাম এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে নিজেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ এবার মনোনয়ন দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাজী আলমগীরকে।
এছাড়া ইসলামী ঐক্য জোটের আব্দুর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশতাক আহমেদ পিনুর মনোনয়নপত্রও নির্বাচন কমিশন বৈধ ঘোষণা করেছে।

ভোটার স্থানান্তরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী আলমগীরবলেন, “আমি কারও নাম বলতে চাই না। তবে একজন মেয়র প্রার্থীই এটা করিয়েছে। যেসব ইউনিয়নে এটা হয়েছে, ভোটারদের সাথে কথা বললেই আপনারা বুঝবেন। ভোটে প্রভাব ফেলতেই এটা সে করেছে।”যে পাঁচ ইউনিয়নের ভোটারদের পৌর শহরে স্থানান্তরের অভিযোগ এসেছে তার মধ্যে কমলাপুর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদের বাড়ি। এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আপনারাই বলেন, সাড়ে তিন হাজার ভোটারের এলাকা বদলে ফেলা হল, এটা কি ছেলে খেলা? এটা কি সম্ভব? এটা করা যদি আমার পক্ষে সম্ভবই হত, তাহলে আমি তো এমপি ইলেকশনই করতাম।”
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ভোটাররা এনআইডি কার্ড নেওয়ার বিষয়ে যে মামুন আর বেলালের কথা বলেছেন, তাদের তিনি চেনেন না। কবির নামে একজন তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে, তবে ভোটার স্থানান্তরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক তার জানা নেই।
তাহলে এ ঘটনা ঘটিয়ে কার লাভ হতে পারে- এই প্রশ্নে মহিউদ্দিন আঙুল তুলেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বর্তমান মেয়র ডা. শফিকুল ইসলামের দিকে।
“আপনারা এলাকায় খোঁজ নিলেই বুঝবেন, তিনিই এসব করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন, কারণ তিনি জায়গা ছাড়তে চান না। তবে মানুষ এখন পরিবর্তন চায়।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে শফিকুল ইসলাম পাল্টা অভিযোগ করেছেন মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধেই।
তিনি বলেন, “এটা আমার করার প্রশ্নই আসে না। গতবার আমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। পৌর এলাকায় আামর বড় একটি ভোট ব্যাংক আছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিতেই মহিউদ্দিন এ কাজ করাচ্ছে।”
ডা. শফিক বলেন, তার পৈত্রিক বাড়ি হল পৌরসভা সংলগ্ন জৈনকাঠী ইউনিয়নে। যদি সত্যিই তিনি ভোটার স্থানান্তরের জালিয়াতি করতেন, তাহলে নিজের সুবিধার এলাকা জৈনকাঠী বাদ দিয়ে মহিউদ্দিনের এলাকা কমলাপুরে কেন তা করতে যাবেন- সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
“ওই এলাকার ভোটারদের জিজ্ঞাসা করলেই পাবেন, এটা আমি করেছি না ওরা করছে?”
ভোটাররা কী বলছেন?
মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর হাজীখালী গ্রামের সাবিত্রী রানি জানান, তার প্রতিবেশীদের মধ্যে অন্তত ১২ জনের ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা হয়েছে একই কৌশল খাটিয়ে।
সাবিত্রীর মতই তার প্রতিবেশী মায়া রানির ভোটার এলাকা স্থানান্তরিত হয়েছে পৌরসভার শাহাপাড়ায়। তবে পাশের বাড়ির পারুল বালার নতুন ভোটার এলাকা হয়েছে পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সবুজবাগ এলাকায়।
কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমার ওয়ার্ডের অন্তত ১ হাজার ৪২ জন ভোটারকে পৌরসভায় স্থানান্তর করা হয়েছে। অথচ ভোটাররা আদৌ কিছু জানেন না।”
মাদারবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ছালাম মৃধাও একই ধরনের কথা বলেছেন। তার এলাকার প্রায় দুইশ ভোটার নিজেদের অজান্তেই পৌরসভার ভোটার হয়ে গেছেন।
“যখন জানতে পারলাম, তখনই আমি নির্বাচন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছি ভোটার ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল। এখন আবার উপজেলা আর পৌরসভার নির্বাচন। তাই ভোটার স্থানান্তর নাকি এখন করা যাবে না।”
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আউলিয়াপুর ইউনিয়নের উত্তর বাদুরা এলাকার মো. বেল্লাল, মো. মানিক কাজী ও নিজাম কাজী নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। অথচ পৌরসভার রেজিস্ট্রারে দেখা যাচ্ছে, তারা পটুয়াখালী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সবুজবাগে ১২৩ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নাজিরা খানম নামে এক নারীর মালিকানাধীন ওই বাড়িতে ওই নামে কোনো ভাড়াটিয়া নেই, কখনও ছিলও না।
মাদারবুনিয়ার সাবিত্রীদের মত আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট আউলিয়াপুর গ্রামের বিধবা হামিদা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্রও মামুন নামের একজন নিয়ে গিয়েছিলেন ত্রাণের সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে।
“পরে আমি যখন বিধবা ভাতা নিতে গেলাম, এলাকার মেম্বার বললো আমার নাম নাকি পৌরসভায় চলে গেছে। মামুনকে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ঘটনা কি। সে আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বলছে কাউকে যেন বিষয়টা না বলি।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রিয়াজ উদ্দিন মামুন পটুয়াখালীতে, কবির ফকির ও বেলাল ফকির এখন আছেন ঢাকায়।
মোবাইল ফোনে মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হামিদা বেগমকে আবার আউলিয়াপুরের ভোটার করা হয়েছে।
কীভাবে তাকে পৌরসভার ভোটার করা হল আর আউলিয়াপুরে আবার কবে স্থানান্তর করা হল জানতে চাইলে তিনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
কবির ফকিরকে ফোন করে কোন বিষয়ে কথা বলা হবে জানাতেই তিনি ফোন রেখে দেন।
নির্বাচন কর্মকর্তার ভাষ্য
পটুয়াখালী সদরের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খালিদ বিন রউফ বলেন, ভোটারের এলাকা স্থানান্তর বা মাইগ্রেশনের জন্য সংশ্লিস্ট এলাকার কাউন্সিলরের সুপারিশসহ আবেদন করতে হয়। সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ড লাগে।
তার দপ্তরের রেজিস্ট্রারের তথ্য দিয়ে তিনি জানান, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত পটুয়াখালী সদরের বিভিন্ন এলাকার ৩ হাজার ৬৬৯ জন ভোটার পৌর শহরের ভোটার তালিকায় স্থানান্তরিত হয়েছেন।
“তারা যথাযথ কাগজপত্র দেখিয়েই আবেদন করেছেন। আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করেই স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে আমার অগোচরে কখনও কিছু হেরফের হয়েছে কি না আমার জানা নাই।”
তবে এ বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকলে আইনগতভাবে তার সমাধান করার কথা বলেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।
তবে পটুয়াখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিজামুল হকের অভিযোগ, এসব ভোটারকে স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর বা সুপারিশের নিয়ম ঠিকভাবে মানা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান খলিফা বলেন, “আমি এ এলাকায় নতুন এসেছি। যে অভিযোগের কথা বলছেন সে বিষয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।”
পটুয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তারিকুজ্জামান মনি বলছেন, যে বা যারাই এর পেছনে থাকুক, তার সুরাহা হওয়া দরকার।
“ভোটার এলাকা বদলে যাওয়ায় গ্রামের অসহায় গরীব মানুষ ভিজিডি, বয়স্কভাতাসহ সরকারের নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসনের এটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।”
সূত্রঃ বডিনিউিজ টোয়ন্টেফিোর ডটকম