Mon. Jun 16th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিই বাঙালি জাতিকে শক্তি দিয়েছিল। চেতনা দিয়েছিল একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জনের। আর এই চেতনাকে বুকে ধারণ করেই ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা।

বৃহস্পতিবার সেই মহান ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে।

বাঙালি জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার, অন্যদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।

১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বরকত সালামকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত, সালাম আমাদের ভালোবাসে। ওরা আমাদের ভালোবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’

এদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে: তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা বরকত, সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’

বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে লিখেছেন ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি- এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোনো আপোস চলে না, চলে না কোনো গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।

ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত জাতি

২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এরই মধ্যে সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। শহীদ বেদীতে আঁকা হয়েছে আলপনা, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দেয়াল লিখন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সড়কেই আঁকা হয়েছে আলপনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। লাল রঙের উপর সাদা রং দিয়ে লেখা হয়েছে আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত একুশের গানের কলি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে একটি শক্তিশালী ‘অমর একুশে উদযাপন কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি’ এবং বিভিন্ন সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী একুশের প্রথম প্রহরে পুস্পার্ঘ্য অর্পণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীমূল প্রস্তুত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একুশের প্রথম প্রহরে ১২টা ১ মিনিটে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর পরপরই শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর কুটনৈতিক ও রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে শহীদ বেদী।

কড়া নিরাপত্তার চাদরে শহীদ মিনার

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থানসহ একুশের প্রভাতফেরি প্রদক্ষিণের এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে শহীদ মিনারে প্রবেশের রোডম্যাপ। এদিন রাজধানী ঢাকার নিরাপত্তায় ১৬ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নিরাপত্তায় কাজ করবে ৬ হাজার পুলিশ সদস্য।

ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া জানান, ‘একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে শহীদ মিনার ও আশপাশের এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর অন্যান্য শহীদ মিনারগুলোতেও সুদৃঢ়, নিরবচ্ছিন্ন ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে চারস্তরের নিরাপত্তা বলয় থাকবে জানিয়ে কমিশনার বলেন, ‘এই এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় থাকবে। শহীদ মিনারের প্রবেশ পথে থাকবে আর্চওয়ে। আগতদের প্রত্যেককে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে প্রবেশ করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকবে ডিবি, সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ক্রাইম সিন ভ্যান। পুরো এলাকা ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে সুইপিং করা হবে।’

র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘একুশের রাতে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেবে র্যাব। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরসহ সারাদেশের শহীদ মিনারগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে র্যাব দায়িত্ব পালন করবে। কেউ যেন নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটাতে না পারে এবং কেউ যেন শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ না করতে পারে সেজন্য র্যাব প্রস্তুত রয়েছে।

২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ছুটির দিন। এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।