Sun. Apr 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
খােলাবাজার ২৪,শনিবার , ০২ মার্চ ২০১৯ঃ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আইনের মধ্যে আছে সীমাহীন সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে বর্তমান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যেভাবে দেশজুড়ে কাজ করে যাচ্ছে, তা সত্যিই একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। সার্বক্ষণিক সদস্য আছেন মো. আলাউদ্দিন। এ ছাড়াও দুজন অবৈতনিক সদস্য ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার এবং মো. আলাউদ্দিন দুজনে মিলে সারা দেশের নদীগুলো যথাসম্ভব পরিদর্শনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শুধু পরিদর্শনের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ করছেন না, একই সঙ্গে কমিশনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা।

বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের ৬০টি জেলায় নদীর প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য সরেজমিন গেছেন। ওই সব জেলার জেলা প্রশাসকসহ জেলা এবং উপজেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেছেন। নদী রক্ষার জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা দুজনই সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ, বয়স তাদের মাঠ পর্যায়ে কাজে কোনো অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি। নদীর জন্য নিবেদিত থেকে নিরলস সময়-শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে নদীবিষয়ক সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছে নদীর জন্য গভীর অনুভূতি থেকে। বাংলাদেশে শুধু নদী নিয়ে কাজ করে এরকম সংগঠনের সংখ্যা খুবই কম। তবে অন্যান্য কাজের সাথে নদী নিয়েও কাজ করেন এ রকম কিছু সংগঠন আছে। আবার নির্দিষ্ট নদী রক্ষার জন্যও অনেক সংগঠন আছে। যেমনি হোক নদী নিয়ে কাজ করার জন্য কিছু সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠনগুলোর সাথে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যুক্ত থাকার যে নীতি গ্রহণ করেছে তা কাছে ভবিষ্যতে নদী রক্ষার এক যৌথ শক্তিশালী চেষ্টায় পরিণত হবে।

বর্তমান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এ চেষ্টাকে স্বাগত জানাতেই হয়। তারা দেশজুড়ে নদী নিয়ে সামজিক উদ্যোগগুলো আছে সেগুলোকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য ছাড়াই প্রাণের তাগিদে যারা কাজ করছেন তাদের কথা শোনা, তাদের সাথে মতবিনিময় করার মতো কাজ কমিশন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঠে যারা কাজ করেন তারাই নদীর প্রকৃত খবর রাখেন। তাদের চেয়ে নদীর খবর সরকারি দপ্তরের লোক বেশি জানেন না। বর্তমান নদী কমিশন এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামাজিক চেষ্টাগুলোকে আরও চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আছে। আমরা যারা রিভারাইন পিপল সংগঠনের মাধ্যমে নদী নিয়ে কাজ করি, তারা প্রত্যেকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত আছি। নদী নিয়ে যে কোনো বিষয়ে নদী কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে উত্থাপন করলে কমিশন বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করে। আমি বেশ কয়েকদিন নদীর সরেজমিন খবর নিয়ে যখনই নদী কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি তখনই তিনি সেসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন।

রংপুরের নীলফামারী সদর উপজেলা ও ডোমার উপজেলার মধ্যবর্তী সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীর পাড় থেকে গত বছর কমিশনের চেয়ারম্যানকে ফোন করেছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম সরকারি কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি মিলে একটি প্রবহমান নদীকে জলমহাল ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে। চেয়ারম্যান মহোদয় তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসকের কাছে কমিশন থেকে ফোন দিয়ে নদীটির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। এরপর নদীটি নিয়ে আমার লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওই নিবন্ধটি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নদীটি সম্পর্কে সচিত্র প্রতিবেদন চেয়েছিল। নীলফামারী জেলা প্রশাসক সেই প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন।

দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীটি স্থানীয় আন্দোলনকারীরা এক দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অবমুক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। নদীটি জলমহাল ঘোষণা হওয়ার প্রক্রিয়াতেই ছিল। রিভারাইন পিপলের পক্ষে আমরা নদী রক্ষা কমিশনকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি কমিশনকে অবগত করেছি। মাঠের আন্দোলন এবং ওপর থেকে নদী কমিশনের আন্তরিকতাপূর্ণ সহায়তায় একটি নদী উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এ দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। এর মধ্য দিয়ে নতুন একটি যুগের সূচনা হয়েছে।

রিভারাইন পিপলের দেওনাই সুরক্ষা কমিটি যখন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সার্বক্ষণিক চেয়ারম্যানকে দেওনাই নদী উদ্ধার উৎসবে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তখন তিনি উদারতার সাথে সম্মত হয়েছেন। ঢাকা থেকে নীলফামারী জেলারও প্রত্যন্ত এলাকা ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নের শেওটগাড়ি গ্রামে দেওনাই নদীপাড়ের উদ্ধার উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। শুধু তাই নয়, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে দখলদারে বিরুদ্ধে ফৌজদারি শাস্তির কথা বলে গেছেন। সরকারি পর্যায়ে যারা নদীটিকে জলমহাল ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তৃতা স্থানীয় আন্দোলবকারীদের ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছে। আন্দোলনকারীরাও একধরনের স্বীকৃতি লাভ করলো, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিগণ আরও দায়বদ্ধ হলেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এখন একটি অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান। হাইকোর্ট এই কমিশনকে বাংলাদেশের নদীর অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আইন করে কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার নির্দেশনাও দিয়েছেন। নিকট-ভবিষ্যতে হয়তো কমিশনের কলেবর আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু নদী নিয়ে যেসব সামাজিক সংগঠন আছে তারা যে সহায়তা দিতে পারবে, নদী কমিশন তা অন্য কারও কাছ থেকে সহজে লাভ করবে না। নদী রক্ষায় যারা আন্দোলন করেন তারাও নদী রক্ষায় কমিশনের সহায়তা পেলে নদী রক্ষার কাজটি ত্বরান্বিত হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং নদীবিষয়ক সংগঠনগুলোর কাজের লক্ষ্য অভিন্ন। এ দুটি চেষ্টা এক স্রোতে প্রবাহমান থাকলে বাংলাদেশের নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবে।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]