রাজধানীর বনানীতে অগ্নিকাণ্ডের কারণে আলোচিত ভবন এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখন বলছে, ভবনটির পুরো নকশা অনুমোদনের একটি নথি তারা খুঁজে পেয়েছে।
ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সংস্থার চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে ভবনটির ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন আছে বলে জানিয়েছিলেন।
এদিকে ভবনটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড দাবি করে আসছে, ২৩ তলার অনুমোদন নিয়েই তারা ভবনটি নির্মাণ সম্পন্ন করেছে এবং ভবনের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে তা যথাযথ উপায়ে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান শনিবার রাতে বলেন, এফ আর টাওয়ারের মূল নথিটি পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা একটি ছায়া নথি পেয়েছি। সেখানে ২৩ তলার অনুমোদনের একটি চিঠি আছে। সেই সঙ্গে একটি অনুমোদিত নকশাও পাওয়া গেছে। এখন এগুলো অন্যান্য রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।
রূপায়ণের কর্মকর্তারা বলছেন, ২৩ তলা পর্যন্ত ইমারত নির্মাণের অনুমোদন নিয়েই কাজ করেছেন তারা। ৮ দশমিক ৮ কাঠা জমির ওপর বাণিজ্যিক এ ভবনের ২৩ তলার সঙ্গে দুটি বেইজমেন্টেরও অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। ভবন নির্মাণের পর রূপায়ণ হাউজিংয়ের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালের ৬ জুলাই ভবনটির মালিক সমিতিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বুঝিয়েও দেওয়া হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ভবন ব্যবস্থাপনার কাজটি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনই করে আসছে।
এ সম্পর্কিত নথিপত্রে দেখা যায়, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে ৮ দশমিক ৮ কাঠা জমির ওপর ১৯৯৬ সালে রাজউকের অনুমোদন নিয়ে ১৮ তলার নকশা অনুমোদন করা হয়। পরে ২০০৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুকের কাছ থেকে আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) বলে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট ভবন সম্প্রসারণের জন্য রাজউকে আবেদন করে। ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিল্ডিং কন্সট্রাকশন (বিসি) কমিটির ৪৪তম সভায় ২৩ তলা পর্যন্ত ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
সেই অনুমোদন পাওয়ার পর রাজউকের তৎকালীন অথরাইজড অফিসার একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দুটি বেইজমেন্ট ও ২৩ তলা ইমারত নির্মাণের অনুমোদনের নথিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি (রাজউক/নঅঅজ৩সি-১৫২৪/৪/২৭১/২৩/২/০৫) স্মারকে অনুমোদনের একটি চিঠি ইস্যু করা হয়।
ভবন নির্মাণকারীদের পক্ষে এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৩ সালে ভূমি মালিকের সঙ্গে ২৩ তলা ভবন নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় রূপায়ণ হাউজিং। চুক্তির পর রূপায়ণ হাউজিংয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক স্থপতি খান মোহাম্মদ আমানতের তত্ত্বাবধানে করা একটি নকশা রাজউকে জমা দেওয়া হয়। এরপর রাজউক থেকে অনুমোদন পেয়ে ভবন নির্মাণের পর ৫৫ ভাগ রূপায়ণ হাউজিং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। আর ভূমি মালিক বাকি ৪৫ ভাগ বুঝে নেন।
তিনি আরও বলেন, ভবনের ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়ে জানতে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনকে রাজউক থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠি পেয়ে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাজুল ইসলাম বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শন করার জন্য আবেদন করেন। এ আবেদনের পর বুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফখরুল আমীনের নেতৃত্বে একটি দল রাজউকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে এ বিশেষজ্ঞ টিম ভবন ব্যবহারে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই মর্মে সনদ দেন।
রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আবদুল মান্নান বলেন, ২০০৮ সালের আগে ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬ অনুসরণ করা হতো। সেখানে ভূমি ছেড়ে দেওয়ার বিধানসহ অনেক কিছুই ছিল না। পরবর্তীকালে ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮’-এ অনেক কিছু নতুন যুক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন (অব.) পি জে উল্লাহ বলেন, ‘আমরা রাজউকের বিধিবিধান মেনে অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছি। পরে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ভবন হস্তান্তর করা হয়। সেই সময়ে ফায়ার হাইড্রেন্টসহ সব ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ইয়াকুব আলী পাটোয়ারীকে প্রধান করে গঠিত কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এ কমিটি ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সার্বিক বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাব। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ভবনের ২৩ তলা পর্যন্ত অনুমোদন ছিল কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘আমরাও শুনছি যে আছে। তবে এ বিষয়ে রাজউক থেকে তদন্ত কমিটি অনুমোদনের কাগজপত্র সংগ্রহের কাজ করছে। তা পেলে বিস্তারিত বলা যাবে।