Mon. Apr 21st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
 

খােলাবাজার ২৪,বুধবার , ২৪এপ্রিল ২০১৯ঃ রক্তে রঞ্জিত হলো আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ও সার্কের অন্যতম সদস্য দেশ শ্রীলঙ্কা। গত ২১ এপ্রিল সকাল শুরু হয়েছিল উৎসবমুখর পরিবেশে। দিনটি ছিল ‘ইস্টার সানডে’। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য দিনটি ছিল আনন্দের, তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।  এদিন তারা পবিত্র মনে গির্জায় প্রার্থনা সভায় একত্রিত হন। এরই মধ্যে ঘটে যায় সহিংস ও অমানবিক ঘটনা- রক্তাক্ত হয় গির্জা, হোটেল, পর্যটনকেন্দ্র। মুহূর্তেই দেশটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে ভয়াবহ এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগে না। কারণ এখন এটা সবাই জেনে গেছেন যে, সেদিন শ্রীলঙ্কায় আটটি সিরিজ বোমা হামলা সংঘটিত হয়েছিল।

দেশটিতে আড়াই দশকেরও বেশি সময় চলেছে তামিল টাইগারদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড! ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। সে-দেশের মানুষ শান্তির সুবাতাস পেতে শুরু করেছিল। তারা রক্তাক্ত অতীত ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু হলো না। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার ৩৫দিনের মাথায় প্রার্থনারত মানুষদের ওপর এই হামলা করা হলো। তামিলবিরোধী দীর্ঘ যুদ্ধাবস্থার কারণে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা গোয়েন্দা কাঠামো অতীতের চেয়ে এখন বেশ কঠোর ও সুগঠিত। তার মধ্যেও এত বড় ঘটনা কিভাবে ঘটে গেল তা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কারা এর পেছনে? নিশ্চয়ই কোনো শক্তিশালী, দক্ষ, সহিংস সংগঠন এর পেছনে রয়েছে। তারপরও হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। কারণ দেশটির ৬-৭ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো জনগোষ্ঠী নয়। তবে ১৯৯৫ সালে একবার গৃহযুদ্ধ চলাকালে আরেক বোমা হামলায় ১৪৭ জন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনার যোগসূত্র আছে কিনা ভেবে দেখার বিষয়। তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সরকারের গৃহযুদ্ধ অবসানের পর এ ধরনের বড় কোনো হামলার ঘটনা এই প্রথম। দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে বৌদ্ধরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম, হিন্দু আর খ্রিষ্টান সম্প্রদায় মিলে মোট জনসংখ্যার প্রায় বারো শতাংশ।

আজ সকালের হিসাব অনুযায়ী সিরিজ বোমা হামলায় ৩৬জন বিদেশি নাগরিকসহ মৃতের সংখ্যা ৩১০-এ দাঁড়িয়েছে। চার শতাধিক আহত হয়েছে যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হতাহত মানুষের সংখ্যার বিচারেই নয়, ঘটনার ব্যাপকতার বিচারেও এই হামলাকে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতম বড় সন্ত্রাসী হামলা বলা যেতে পারে। হামলার ধরন, ব্যাপকতা ও স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বলা যায় এটি হঠাৎ করে হয়নি। এর পেছনে পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত কৌশলী, সময়সাপেক্ষ ও সুপরিকল্পিত। প্রশ্ন হচ্ছে শ্রীলঙ্কান গোয়েন্দারা কেন তা আঁচ করতে পারলো না। খবরে প্রকাশ ১১ এপ্রিল দেশটির পুলিশপ্রধান দেশের সর্বত্র পাঠানো একটি গোয়েন্দা বার্তায় বলেছিলেন যে, দেশের উল্লেখযোগ্য গির্জাগুলোয় আত্মঘাতী বোমা হামলা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন কিন্তু কেন তারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি সেটিও একটি বিরাট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রহস্যের জট এখানেও পাকিয়ে আছে। পুলিশপ্রধানের সতর্কবাণীতে নাকি বলা হয়েছিল- একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল তৌহিদি জামাত’ নামে একটি সংগঠন এই ধরনের কাজ করতে পারে বলে জানিয়েছিল। তবে, তাদের সাংগঠনিক কোনো সক্ষমতার কথা তাদের  জানা ছিল না। ঘটনার পর সংগঠনটিও এর নিন্দা জানিয়েছে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি করেছে। এতে সন্দেহ আরও ঘণীভূত হচ্ছে। যে কোনো বড় হামলা করতে হলে স্থানীয় লোকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনা অপরাধ বিজ্ঞান স্বীকার করে। সুতরাং স্থানীয়রাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। স্থানীয় কারা জড়িত ছিল, কি এর পেছনের কারণ তা জানার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

যে কোনো হামলার পেছনে একটি বার্তা থাকে। শ্রীলঙ্কায় হামলার পেছনের কোনো বার্তা এখনও আমরা বুঝতে বা জানতে পারিনি। তাহলে কোনো বার্তাই কি নেই? বার্তা না থাকার মানে হচ্ছে হামলার দায় যে কারও ওপরে চাপিয়ে দেয়া যায় বা যাবে। খ্রিষ্টানদের মাঝে তামিল ও সিংহলি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তামিলরা যদিও সংখ্যায় বেশি, তামিলপ্রধান উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে এবং কলম্বোতে বেশি খ্রিষ্টান বসবাস করে। হামলা হয়েছে কলম্বো ও পূর্বাঞ্চলের বাত্তিকালোয়াতে। এই হামলার পেছনে হিন্দু, তামিল ও বৌদ্ধ সিংহলিদের সংশ্লিষ্টতার বড় কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তামিলদের সঙ্গে সিংহলিদের যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাতে খ্রিষ্টানকেন্দ্রিক কোনো উপাদান নেই। আবার হিন্দু, তামিল ও খ্রিষ্টান তামিলদের মাঝেও বড় ধরনের কোনো সংঘাত নেই। অতীতে মুসলমান তামিলদের সঙ্গে এলটিটিই’র সম্পর্ক খারাপ  থাকলেও দলটির মূল নেতৃত্ব কাঠামোতে ছিল নিন্মবর্ণের হিন্দু, খ্রিষ্টান নয়। সম্প্রতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কায় যেসব আক্রমণ হয়েছে সেটাও হয়েছে বৌদ্ধ সিংহলি কিছু সংগঠন দ্বারা। খ্রিষ্টান সিংহলিদের তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে এটি এমন কোনো তৃতীয় শক্তি করেছে যা একটি পরিপূর্ণ সন্ত্রাসী হামলা। এই হামলার প্রভাব যে শুধু শ্রীলঙ্কায়ই থাকবে না সেটি আমাদের বুঝতে হবে। এর ফল সুদূরপ্রসারী।

সেদিনের আটটি হামলার অধিকাংশই আত্মঘাতী। এই ঘটনায় শ্রীলঙ্কার মুসলিম সমাজও অবাক। স্মরণাতীত কাল থেকে সামাজিকভাবে মুসলিমরা সেখানে কোনঠাসা। এ মুহূর্তে যে কোনো ঘৃণামূলক প্রচারণা তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। মুসলিম রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে বিক্রমসিংহকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তামিল সংগঠনগুলোও একই সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশটিতে সম্প্রতি মুসলমানদের সঙ্গে আর কারও সংঘাতপূর্ণ কোনো সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়নি। আবার চার্চের সঙ্গে মসজিদ বা প্যাগোডাকেন্দ্রিক সহিংস কোনো বিষয় সেদেশে এর আগে লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে পুরো বিষয়টি ধোয়াশার মধ্যে পড়ে আছে। এই অবস্থা নিশ্চিতভাবেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বিশাল এক অবিশ্বাসের জন্ম দেবে এবং ধর্মভিত্তিক সমীকরন আরও জটিল করে তুলবে।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলার ক্ষত এখনো শুকায়নি। এরই মধ্যে নরপিশাচদের বোমায় আবারও আক্রান্ত হলো বিশ্বমানবতা। রাক্তাক্ত হলো কলম্বোর মাটি। বিশ্বজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বিশ্বব্যাপী যে এই নিষ্ঠুরতার প্রতিযোগিতা চলছে এর শেষ কোথায়? সরল ও সাধারণ বিশ্বাসে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা করতে গিয়ে যদি মানুষকে এই পরিণতি বরণ করতে হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বিশ্বকে যারা অগ্নিকুণ্ডলীতে পরিণত করছে তারা কারা? কারা তাদের মদদ দিচ্ছে, সহায়তা করছে, চিন্তা করতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বনেতাদের গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে হবে। কারা কেন কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, কে বা কারা ভুলের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবীকেই এখন একসঙ্গে শান্তির জন্য কাজ করতে হবে। মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্য কাজ করতে হবে। প্রতিটি দেশ– ধনী হোক গরিব হোক সবাই যেন ব্যস্ত সামরিক খাতে খরচ বাড়াতে।  অথচ সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নেই, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিরাপদে নেই, কোনো জনগোষ্ঠী নিরাপদে নেই। অথচ বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের মজুত বাড়ছে। সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রীয় অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখে অনেক দেশ শুধু সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে চলছে। এগুলো কখনও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। কেননা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, অস্ত্রের দ্বারা সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক