Fri. Apr 25th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
খােলাবাজার ২৪, সোমবার ১৭ জুন ২০১৯ঃ নেতা হবেন তিনি, যিনি অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন। আর অনুসারীরা নেতার নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে কাজ করবেন এবং তাঁর আদেশ মেনে চলবেন। অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার যখন-তখন খবরদারি করা বোঝায় না। আদর্শ, দর্শন ও নীতি-নৈতিকতা নিজে মেনে চলা ও অনুসারীদের মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা এবং এর সম্প্রসারণের কাজ নেতা ও অনুসারীদের উভয়েরই। যিনি এ কাজে পারদর্শী এবং যাঁর কথা অন্যরা অনুসরণ ও অনুকরণ করেন, তিনিই সফল নেতা বনে যান। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অন্যের ওপর অন্যায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতাই আমরা বাস্তবে বেশি দেখতে পাই। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা অনেক সফল নেতার সন্ধান পাই, যাঁদের নেতৃত্ব ছিল সঠিক এবং অনুসারীরা ছিলেন অনুগত। কিন্তু আজকালকার নেতাদের মধ্যে নেতৃত্বের মহৎ গুণাবলির পরিবর্তে ক্ষমতা প্রয়োগের মোহ বেশি প্রাধান্য পায়। নেতৃত্বের প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে গলদ ও অসামঞ্জ্যসতা থাকায় সঠিক নেতৃত্ব তৈরির পথ রুদ্ধ হচ্ছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্রোহী অনুসারীদের আবির্ভাব ঘটছে। অনুসারীরা একক নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে না দেখে ভিন্ন ভিন্ন বলয় তৈরি করছেন। নেতারা নিজেদের বলয়কে শক্ত ও মজবুত করার জন্য অনুগত অনুসারী তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। দলের চেতনা-আদর্শ বিস্তারে তাঁদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়।

নেতা ও নেতৃত্বের মধ্যে চেয়ে অনুসারীদের কর্তৃত্ব আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অনুসারীদের কর্তৃত্ব সম্পর্কে নেতারা কখনো ওয়াকিফহাল আবার কখনো না। নেতা যদি দূরদর্শী না হন, তাহলে অনুসারীদের সম্পর্কে ভালো জানা সম্ভব নয়। সংগঠনে রয়েছে পদবি কিন্তু অনুসারীদের ক্ষেত্রে কোনো সংখ্যা নেই, নেই কোনো ডাটা বেইস। ফলে অনুসারী হওয়া সহজ। নেতার নাম বলে দিলেই হলো। সাধারণ জনতা নেতাদের চেয়ে অনুসারীদের ভয়ের চোখে দেখে।

দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন ও দল পরিচালনায় সঠিক পথ অবলম্বন করা হলে নেতাদের নেতৃত্ব সঠিক হতো এবং অনুসারীরাও নীতি, আদর্শ চর্চা ও অন্যকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। অনুসারী তৈরির পথ প্রশস্ত হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। দল ও সংগঠনে গণতন্ত্র চর্চা সহজ বিষয় নয়। দলে ভিন্ন ভিন্ন বলয় এমনিতে তৈরি হয় না।

অতীতেও রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও উপদল ছিল এবং এ কারণে দল ভেঙেও যেত এবং এখনো যায়। নতুন নতুন দলের সৃষ্টি হয়। ক্ষতি নেই কিন্তু রাজনৈতিক কাঠামো যখন বড় বড় দল নিয়ন্ত্রণ করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে, তখন নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও অনুসারী হওয়ার চেষ্টা বেশি থাকে। তারা মনে করে সরকারে থাকাই সব কিছু। শুধু নাম ব্যবহার করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পাঁয়তারার চেষ্টা দেখা যায়। শুধু কী সাধারণ জনগণ, বড় বড় মানুষও তাঁদের ভয় পান, ছাড় দেন এবং এর মাধ্যমে কোনো না কোনো সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নেন। আমাদের সীমাবদ্ধতা আমরা যেমন নির্ভেজাল নেতা তৈরি করতে পারছি না। ফলে তাঁদের দ্বারা যে অনুসারী তৈরি হচ্ছে তাদের কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে দল, সংগঠন ও এর ভিত্তিতে নেতাকর্মী ও অনুসারীদের সংখ্যা অনেক। দল ও সংগঠনের মধ্যে রয়েছে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। এত কিছুর মধ্যে কে নেতা, আর কে কর্মী ও অনুসারী তার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কোনো এক নেতার সঙ্গে ঘুরলে অনুসারী হওয়া যায়। সদস্য হওয়ার দরকার পড়ে না। সামনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এই কাউন্সিলকে সামনে রেখে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। যিনি নেতা হবেন, তিনি মনে-প্রাণে দলের হয়ে কাজ করবেন। নিজের একক কোনো অনুসারী তৈরি করবেন না। একক অনুসারী রাজনীতির মাঠে কোনো চেতনার জন্ম দিতে পারেন না। ভালো অনুসারী তৈরিতেও কোনো ভূমিকা রাখে না। পরিশীলিত ও শুদ্ধ রাজনীতির জন্য সঠিক নেতৃত্ব এবং এর মাধ্যমে ভালো অনুসারী দরকার। এমন ভীতিকর কর্তৃত্ব নয়। দলের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং নীতি ও আদর্শ সম্প্রসারণে অনুসারীরা কাজ করবেন। নেতাদের নিজের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য অনুসারী তৈরির কাজ থেকে আমাদের অবশ্য সরে আসতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়