খােলাবাজার ২৪,শনিবার, ২৯ জুন,২০১৯ঃ হানিফ সংকেতকে শুধু একজন বিনোদনশিল্পী হিসেবে চিন্তা করলে ভুল করা হবে। আমি তাঁকে দেখে থাকি মূলত একজন সমাজদর্শী হিসেবে। বিনোদনশিল্পকে তিনি তাঁর ভাবধারা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি হয়তো তাঁর জীবিকার সম্পূরক অংশ হিসেবেও কাজ করে; লেখালেখি কিংবা টেলিভিশনের টক শো যেমন অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তির সম্পূরক আয়ের শীর্ণকায় অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সংকেতের নিবন্ধগুলো কলাম হিসেবে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তা রম্য রচনার আঙ্গিকে লেখা। অনেক সময় এতে ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার করা হয়। এতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। লেখককে তাই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। নিজের অজান্তে কাউকে আহত করে বিপদে না পড়লেও ঝামেলায় পড়তে পারেন। সে রকম পরিস্থিতির উদ্ভব যেন না হয়, সেটি আমাদের প্রত্যাশা।
যে দুস্তর প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নাগরিকের জীবনকে অস্বস্তিকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, হানিফ সংকেত তার একটি প্রকৃষ্ট ছবি সাম্প্রতিক নিবন্ধে তুলে ধরেছেন। কাউকে ছোট-বড় করার জন্য নয়, কোনো পক্ষ অবলম্বন করে কাউকে খুশি করার জন্য নয়, তাঁবেদারি-মোসাহেবির উদ্দেশ্যে নয়। আমার মনে হয়েছে, সমাজদেহের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে পাঠককে তথা জনসাধারণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তিনি কালি-কলম, রংতুলি ব্যবহার করেছেন। সমাজদেহের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্যাগুলো বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন অবস্থানে বিরাজমান থাকে। প্রথম দিকে অনেকেই সমস্যাগুলোকে দেখতে পায় না, এর তীব্রতা অনুভব করে না। সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে জনগোষ্ঠীর একাংশকে অধিকাংশ সমস্যা স্পর্শ করে না। তারা ভালো থাকে। সমস্যার অস্তিত্বই তারা স্বীকার করতে চায় না। সমস্যা কিন্তু বাড়তে থাকে।
গাণিতিক নিয়মের সোজা পথে হেঁটে আমরা জিডিপির পরিমাপ করি। এ পরিমাপের যথার্থতা নিয়ে সুধীমহলে তো বটেই, এমনকি অর্থশাস্ত্রের পেশাজীবী মহলেও সরব বির্তক রয়েছে। মনে রাখতে হবে, জিডিপি একটি নামিক চলক (Nominal Variable)| এর প্রবৃদ্ধিও নেই। নামিক চলকের নির্মাণে নানারূপ ফাঁকফোকর থাকে। বিভিন্ন কৌশলে একে বাড়ানো-কমানো যায়। সংজ্ঞা নির্ধারণ, উপাদান নির্বাচয়ন, উপাদান (Input) এবং উৎপাদ (Product)-এর মূল্যমান নির্ধারণ এবং সর্বোপরি ভিত্তিরেখা পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে জিডিপির আকার ও এর প্রবৃদ্ধির হার। আমাদের দেশে জিডিপির পরিমাপে নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত দুবার ভিত্তিরেখা
(Base line/year) পরিবর্তন করা হয়েছে। সম্প্রতি ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম, তাঁর প্রবন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে সরকার তার প্রয়োজন ও ইচ্ছা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখাতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘২০১১-১২ ও ২০১৬-১৭ সালে পদ্ধতিগত পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রতিবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি শতকরা ২.৫ পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। আর ওই সময় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) উভয় দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। সরকারি হিসাব অনুসারে ওই বছরগুলোয় গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ। যদিও প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪.৫ শতাংশ। তা ছাড়া ৯৫ শতাংশ মানুষই বিশ্বাস করে, প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ৩.৫ থেকে ৫.৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।’ (বণিক বার্তা, ১৮ জুন ২০১৯)
জিডিপি ও এর প্রবৃদ্ধির সহজ গাণিতিক হিসাবে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। স্বাধীনতা-উত্তর বছরসমূহে কিংবা সহস্রাব্দের প্রারম্ভে আমরা যে অবস্থায় দিন কাটিয়েছি, বর্তমান সময়ে তার তুলনায় আমাদের ধন-ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং বিদেশ তথা সারা বিশ্ব থেকে সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের ভোগ্যপণ্যের সম্ভার বেড়েছে, চোখে পড়ার মতো কিছু অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, বিদেশের সঙ্গে আমাদের লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মিথস্ক্রিয়া অনেক বেড়েছে। আমরা এখন আর ছোট্ট পরিধিতে আবদ্ধ কতিপয় মানবসন্তান নই, আমরা এখন বিশ্ব চরাচরে স্থান করে নেওয়া সারিবদ্ধ বাংলাদেশি নাগরিক।
হানিফ সংকেত তাহলে দেশের মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখছেন কেন? তিনি তো বিনোদন জগতের লোক। সবাইকে খুশি রাখার জন্য, আনন্দ দেওয়ার জন্য কত রকম উদ্ভাবনীমূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন। তাহলে বুঝতে হবে, তাঁর অস্বস্তি ও উদ্বেগের নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণ রয়েছে। খালি চোখে এর বেশির ভাগই দেখা যায়। তবে কিছু কারণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। উন্নয়নের সরল বৈষয়িক ‘প্যারামিটার’ ছাড়াও যে দুটি বিষয় উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার একটি হচ্ছে জীবনমান এবং অন্যটি হচ্ছে জীবনযাপন। আমাদের অবস্থা ভালো হয়েছে বললে বুঝতে হবে মাথাপিছু আয় ছাড়াও আমাদের জীবনমান উন্নত হয়েছে এবং আমাদের জীবনযাপন সহজ, নির্বিঘ্ন ও আনন্দদায়ক হয়েছে।
গাণিতিক নিয়মে দেশের সম্পদ বেড়েছে, সম্পদ বাড়ার গতিও বজায় রয়েছে। দেশের বাসিন্দাদের একাংশের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। তাদের ঘর-বাড়ি, আসবাব, যানবাহন, তৈজস সামগ্রী, খাবারদাবার সবই উঁচুমানের। হানিফ সংকেত বিলাসী মানুষগুলোকে ঠিকই দেখেছেন। তবে তাঁর লক্ষ্যবদ্ধ দৃষ্টি সাধারণ মানুষের দিকে। তাদের মধ্যে তিনি স্বস্তি দেখছেন না। সুখের বাতাস তাদের গায়ে লাগে না। একধরনের অস্বস্তি, আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা তাদের নিরন্তর আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘরে দুবেলার খাবার থাকলেও নির্বিঘ্নে, নির্ঝঞ্ঝাটে জীবন কাটানোর নিশ্চয়তা তারা খুঁজে পায় না। অদূরভবিষ্যতের দিনগুলো শান্তিতে কাটবে কি না সে সম্পর্কে তারা কিছুই বলতে পারে না। চারদিকে অনিশ্চয়তা, ঝামেলা।
পরিবারকে হানিফ সংকেত সমাজের ভিত্তি ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেখানে তিনি সমস্যার বীজ উত্তপ্ত দেখেছেন। বিভিন্ন রকম আসক্তি, যেমন প্রযুক্তিকেন্দ্রিক আসক্তি, মাদকাসক্তি, একাকিত্বের আসক্তি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একধরনের সর্বনাশা বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করেছে। পারিবারিক পর্যায়ে সংঘবদ্ধ জীবন হারিয়ে যাচ্ছে, সংযোগবিচ্ছিন্ন একাকী দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে তরুণ সদস্যরা আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা স্বার্থান্ধ হয়ে নিজের মতো ভেসে যাচ্ছেন। কেউ কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। দিনশেষে সবাই ভয়ার্ত, দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন।
সড়কপথে যাত্রী হিসেবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ারকালে দুশ্চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। যাত্রীসাধারণকে কতক্ষণ রাস্তায় থাকতে হবে সে সম্পর্কে পূর্ব ধারণা তো দূরের কথা, রাস্তায় যখন যানজটে গাড়ি আটকে আছে, তখনো কেউ কোনো ধারণা দিতে পারবে না। খাওয়াদাওয়া করা এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। কী খেতে গিয়ে কী খাচ্ছি তা বলা যাচ্ছে না। সরল বিশ্বাসে বিষাক্ত খাবার খেয়ে হয়তোবা শরীরে রোগবালাই ডেকে আনা হচ্ছে। জিনিস কিনতে গিয়েও দুশ্চিন্তা, কিনে আনার পরও দুশ্চিন্তা। জিনিসটি যদি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হয়, তবে তো কথাই নেই। জীবননাশের চিন্তা আপনাকে কুরে কুরে খাবে। ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া টেকনিশিয়ান, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি ভুয়া সচিবে দেশ ছেয়ে গেছে। এদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার সহজ উপায় নেই।
শারীরিক নিরাপত্তা বড় চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে। কোথায় কে শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপনার আপনজন, আত্মীয়-স্বজন যদি মহিলা বা শিশু হয়, তবে দুশ্চিন্তার তীব্রতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ধর্ষণ, হত্যার মহিলা-শিশু ভিকটিমের মর্মস্পর্শী কাহিনি খবরের পাতা ভরে থাকে। প্রশ্ন ওঠে : এরা কী এই বর্বরতার শিকার হওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছিল। কেন এই করুণ পরিণতি?
অর্থসম্পদের সুরক্ষণের ব্যাপারে সাধারণভাবে মানুষ একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। কষ্টার্জিত অর্থ হারিয়ে গেলে, চুরি বা ছিনতাই হলে, অপহৃত হলে মানুষ শোকে-দুঃখে পাগলপ্রায় হয়ে যায়। সাবধানী মানুষ তাই বাড়ি-ঘরে অর্থসম্পদ জমা না রেখে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তা আমানত রাখে। আমানতকারী ধরে নেয় তাদের অর্থ এসব প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ থাকবে। যখন তারা শুনতে পায় যে ব্যাংকের টাকা প্রভাবশালীরা নানা অপকৌশলে লুটে নিয়েছে, ব্যাংকগুলো তারল্যশূন্য, তখন তাদের দুশ্চিন্তার সীমা থাকে না।
শেষের দিকে আসি শিশু, কিশোর ও নাগরিকের শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনায়। একসময় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সুনাম ছিল। এ দেশের ছাত্রদের কৃতিত্ব বিদেশেও স্বীকৃত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এখন সে সুনাম হারিয়ে গেছে, আমাদের পাবলিক পরীক্ষার সনদ ও গ্রেড নিয়ে শিক্ষার্থীরাও হাসাহাসি করে। নিজেদের গ্রেডের ওপর তাদের আস্থা নেই। এশিয়ার ৪০০ উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। আমরা কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি?
একটি অতিপরিচিত চুটকি দিয়ে লেখা শেষ করছি। এক ভদ্রলোক গণককে হাত দেখানোর পর গণক বলল, সামনে অনেক ঝামেলা, অনেক সংকট দেখা যাচ্ছে। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। ভদ্রলোক তখন গণককে জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কী হবে? গণক বলল, চিন্তার কোনো কারণ নেই। ধীরে ধীরে সব সয়ে যাবে। যাবতীয় সংকট, সমস্যা নিয়ে আপনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন। সব দেখেশুনে ভয় হচ্ছে: দুশ্চিন্তা কী আমাদের জীবন থিতু হয়ে যাবে? প্রার্থনা করি এমন অবস্থা যেন না হয়। যাবতীয় দুশ্চিন্তা যেন শিগগিরই কেটে যায়।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান