বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি।
বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সরকারি নিয়মে শিশুদের বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীতে ভর্তি করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ওই শ্রেণীতে পড়ার দক্ষতা শিশুটির নেই।
এই শিক্ষিকা বলেন, বয়স দেখে হয়তো একটি শিশুকে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি করা হয়, কিন্তু পরে দেখা যায় যে সে বাংলা-ইংরেজি রিডিং পড়তে পারে না। কিছু বাচ্চা হয়তো অক্ষরই চেনে না।
একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের সবার প্রতি আলাদা আলাদাভাবে নজর দেয়া রীতিমত অসম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একেকটা ক্লাসে ৫০-৬০ জন ছাত্র ছাত্রী থাকে। এতজন শিক্ষার্থীকে ধরে ধরে বোঝানো তো সম্ভব না। শিশুর বাসাতেও কিছু প্র্যাকটিস করতে হয়, পড়তে হয়, হোমওয়ার্ক করতে হয়। সেই সাপোর্টটা তারা পায় না। কারণ অনেক বাচ্চার বাবা-মা পড়াশোনা জানেন না।
দুর্বল শিক্ষার্থীদের কাছে পঠন প্রক্রিয়া সহজ করে তুলতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে অধিকাংশ সময় সেই প্রশিক্ষণ নিয়মিত হয়না। বিবিসি বাংলা-কে ওই শিক্ষক জানান, বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষকের বছরের পর বছর কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ হয় না।
বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার এশিয়ায় মধ্যে সবচেয়ে কম। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন তথ্য জানা গেছে।
সমস্যা রয়েছে আরো। শিক্ষার্থীদের অনুপাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ শিক্ষকের অভাব তো রয়েছেই। যে ক’জন আছেন তারাও তাদের পুরো সময় পাঠদানে দিতে পারেন না।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শেখ ইকরামুল কবির জানিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোট গ্রহণ, এমনকি গ্রামের পাকা পায়খানা বানানোর কাজটাও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা করেন। এবং এই সব কাজ স্কুল খোলা থাকার সময় হয়। ফলে শিক্ষকদের যতো শিক্ষা ঘণ্টা পাঠদান করানোর কথা ততক্ষণ তারা পাঠদান করাতে পারছেন না। এসবের মাঝে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন শেখ ইকরামুল কবির।
শিক্ষকদের অল্প বেতন, সেইসঙ্গে মর্যাদাও কম হওয়ায় এই পেশার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
এসব কারণে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া একজন শিক্ষার্থীর যে পরিমাণ জ্ঞান থাকা দরকার তার অর্ধেকও তারা অর্জন করতে পারে না বলে মত প্রকাশ করেছে ওই প্রতিবেদনে।
এমন অবস্থায় শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রাথমিকের প্রতিটি দুর্বল শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়ার কথা জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ওই প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেন জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক এবং ইউনেস্কোর প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী বছরের মধ্যে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্বল শিক্ষার্থীদের সবল করে তোলার বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার হবে। প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষকতার বাইরে তাদের যেন বাড়তি কাজ করতে না হয় সেদিকটাও মনিটর করা হবে বলে জানান তিনি।
মো. আকরাম আল হোসেন আরো জানিয়েছেন, প্রতিটি স্কুলে গণিত অলিম্পিয়াড চালুর ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া শিশুদের রিডিং ও রাইটিং এর উন্নয়নে ‘ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড’ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। যেখানে প্রতিটি শিশুকে একদিন একটা ইংরেজি শব্দ এবং একটি বাংলা শব্দ শেখানো হবে।
তবে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুই কোটি ১৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে ২০২০ সালের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া রাতারাতি সম্ভব নয় বলে মনে করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্য জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রবর্তন করা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের সমন্বয়হীনতা এবং বিনিয়োগের অভাবকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সরকার সবার জন্য শিক্ষা বিষয়টার দিকে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে শুধু সংখ্যার দিকে মনযোগ দিয়েছে। সংখ্যা কিন্তু আমরা অর্জন করতে পেরেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুরা কতোটা জ্ঞান অর্জন করল, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া।
এজন্য শিক্ষার্থীদের বয়স উপযোগী পাঠ্যক্রম সাজানোর পাশাপাশি তাদের উপযোগী শিক্ষা উপকরণ প্রতিটি স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে সরবরাহ করা জরুরি বলে তিনি জানান।
কিন্তু পুরো এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ জিডিপির হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সবচেয়ে কম। এই খাতে বিনিয়োগ না করলে, শিক্ষকদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে না তুললে, সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায়ন করা না হলে মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী।
এবার সরকারের এসডিজি প্রকল্পের লক্ষ্য শুধু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানো নয় বরং তাদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।