খােলাবাজার ২৪,সোমবার,১৮নভেম্বর,২০১৯ঃমোস্তাক আহমেদ মনির, সরিষাবাড়ী (জামালপুর) : জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের পুঠিয়ারপাড়া গ্রামের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে সিদ্দিক আলবদর ওরফে জল্লাদ সিদ্দিকের (৬৮) বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ঢাকায় গত ৫ নভেম্বর মামলাটি স্থানান্তর করা হয়। বাদিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট আব্দুল বারী-২ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলায় তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী নিরীহ বাঙ্গালীদের পাকবাহিনীর হাতে সোপর্দ, হত্যা ও হত্যায় সহযোগিতাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। ইজারাপাড়া (গোনারপাড়া) গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী মোছাঃ জহুরা বেগম বাদি হয়ে গত ১৪ অক্টোবর সিআর আমলী আদালত সরিষাবাড়ী, জামালপুর-এ মামলাটি দায়ের করেন (যার নম্বর ৩১৩ (১) ২০১৯)। মামলায় পোগলদিঘা ইউপি চেয়ারম্যান সামস উদ্দিন, ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ফজলুল হক, আটজন মুক্তিযোদ্ধা ও জল্লাদ সিদ্দিকের বড়ভাই আব্দুর রশিদসহ মোট ২৬ জনকে স্বাক্ষী করা হয়েছে।
মূল এজাহারের সাথে এলাকাবাসীর গণস্বাক্ষরযুক্ত স্মারকলিপি ও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদসহ ২০ ফর্দের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোলায়মান কবীর মামলাটি আমলে নিয়ে জল্লাদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪৪৮/৩০২/৪৩৬/৩৭৯/৩৮০/৩২৩/৩২৫ ধারা মতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ঢাকার বিচারক বরাবর প্রেরণ করেছেন (যার স্মারক নম্বর ৩৯৭, তারিখ ৫-১১-২০১৯ইং, জিপি নম্বর ৫৮৬)। এদিকে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পর আসামী বাদি ও স্বাক্ষীদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার মূল এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সরিষাবাড়ীতে আলবদর বাহিনী গঠন করে নিজে বাহিনী প্রধান হয়ে জল্লাদের ভূমিকা পালন করে। বাদির ভাই মৃত আব্দুল কাদের ও মৃত আব্দুল হাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর (রবিবার) ভোরে সরিষাবাড়ীর বাউসি ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর জীবিত মুক্তিযোদ্ধাগণ বাদির বাড়িতে আশ্রয় নেনÑ এই সংবাদে স্বাধীনতাবিরোধীরা একযোগে বাদির বাড়িতে হামলা করে। তারপর বাদি, কতিপয় স্বাক্ষী ও বাদির চাচাতো ভাই মৃত আব্দুল কাদেরকে ধরে নির্যাতন চালায়। এ সময় আসামী জল্লাদ সিদ্দিক আব্দুল কাদেরকে সরাসরি বুকের বাম পাশে গুলি করে হত্যা করে। একই সময় তার নেতৃত্বে বাদির বাড়িঘরে লুটতরাজ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় বাদির নেতৃত্বে পুঠিয়ারপাড় গ্রামের ভোলা সাহা, চান মোহন সাহা, রাধা বর্মন সাহা ও সুরেশ সাহাকে হত্যা করা হয়। গোপিনাথপুর, বয়াসিং গ্রামের তৈয়ব আলী (আগু মন্ডল), নছর মন্ডল, সৈয়দ মন্ডল, আব্দুস ছাত্তার, ইনতুলি মুসুল্লিকে হত্যা, তাদের বাড়িঘরে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আরামনগর বাজারের হিরেন্দ্র কুমার প্রামাণিক, কালিপদ কর্মকার, বাদল কর্মকার ও ঝন্টু কর্মকারকে আসামী হত্যা করে। সে শুয়াকৈর গ্রামের আমির হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে নিরীহ বাঙ্গালী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন, বাড়িঘরে হামলা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ নানা অপরাধের ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
এজাহারে আরো বলা হয়েছে, আসামী দেশ স্বাধীনের পর পালিয়ে সৌদি আরবে চলে যায়। ৩/৪ বছর আগে দেশে ফিরে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অন্যের জমি দখল, তুচ্ছ কারণে নীরিহ লোকদের মারধর, খুন-জখমের হুমকি, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ পারিবারিক প্রভাব ও অত্যাচারে গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বারবার শালিস-বৈঠকে সাবধান করায় উল্টো সে গ্রামের মাতব্বরদের হাত-পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয়। এসব বিষয়ে ইউএনও অফিস ও থানায় বারবার লিখিত অভিযোগ দিলেও প্রতিকার পাননি এলাকাবাসী।
বাদিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট আব্দুল বারী-২ জানান, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে সিদ্দিক আলবদর ওরফে জল্লাদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে করা মামলাটি বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ন্যাস্ত করেছেন। ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
এদিকে মামলার স্বাক্ষী (আসামীর ভাই) আব্দুর রশিদ অভিযোগ করেন, আসামী বাদি ও স্বাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। তার বাড়ির দিকে আসামী সিসি ক্যামেরা বসিয়ে গতিবিধি নজরে রাখছে। তার ভয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছে না।