খােলাবাজার২৪,সোমবার,২৩ডিসেম্বর,২০১৯ঃফারুক আহমেদঃ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের সুতীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানিয়ে এই লেখা।
জামিলায় মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ুয়াদের উপর অমানবিক লাঠিচার্জ করে দিল্লি পুলিশ। কাঁদানে গ্যাসের সেলও ফাটানো হয় এবং অভিযোগ উঠছে লাইব্রেরিতে ঢুকে ভাঙচুর করে জাতীয় সম্পত্তি নষ্ট করেছে তারা। গোটা দেশের মানুষ ছিঃ ছিঃ করে ধিক্কার জানাচ্ছেন এই ঘটনার।
গোটা পৃথিবীর শুভ বুদ্ধির মানুষও নিন্দা জানিয়েছেন। আবার অনেকেই তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে পথেও নেমেছেন। কলকাতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ছাত্র-ছাত্রীরা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ুয়াদের উপর অমানবিক লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে আন্দোলন করছেন। বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে দিল্লির পুলিশ তাণ্ডব চালিয়েছে যা জাতীয় লজ্জা বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করছেন। অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করতে হবে, এই দাবীও উঠছে সর্বত্র
ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে পদদলিত করে, ভারতীয় সংবিধানের আত্মাকে অপমানিত করে যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক নাগরিকত্ব আইন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার রূপায়িত করতে চাইছেন, আমরা তাকে তীব্র ধিক্কার জানাই। এই বিদ্বেষমূলক আইনের প্রতিবাদে যে সমস্ত মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তাঁদের সকলের কাছে আবেদন, আইন হাতে তুলে নেবেন না, দেশের মানুষের কল্যাণে সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ-আন্দোলনকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবার জন্যে আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। আমরা জানি সামনের দিনগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে অখণ্ড স্বাধীন ভারতকে রক্ষা করতেই হবে। এটাই হোক আমাদের জান-মান নিয়ে বাঁচার অগ্নিশপথ।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আবেদন “গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করুন, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পথ অবরোধ, রেল অবরোধ করবেন না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বরদাস্ত করা হবে না। যাঁরা গন্ডগোল করছেন, রাস্তায় নেমে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন, তাঁদের কাউকে ছেড়ে দেওয়া হবে না। বাসে আগুন লাগিয়ে, ট্রেনে পাথর ছুড়ে, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ভারতের বহু সমাজ সচেতন মানুষ, বিদেশের মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ুয়াদের উপর বর্বরোচিত পুলিশ হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের ভুল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে আন্দোলন করছেন।
ভারতের সংবিধানের উপর চরম আঘাত এসেছে, সংবিধানকে রক্ষা করতেই হবে।
সংবিধান বিরোধী সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করতে ভারতের জনগণ পথে নেমেছেন এবং সভা-সমাবেশ ও আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাও তীব্র গতিতে আন্দোলনের মাত্রা বাড়িয়ে নয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
আমরা জানি বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না দেশের সাধারণ মানুষ। তাঁরা জানেন ভারত হল বৈচিত্র্যময় নানা ভাষার নানা জাতের মানুষের মিলন ক্ষেত্র। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ দেশ হল ভারত। মিশ্র সংস্কৃতি আমাদের অর্জিত বৈভব, আর তা আমরা কখনোই নষ্ট হতে দেব না।
কংগ্রেস দলের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জামিলায় মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। দেশের আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। পুলিশ আইনের রক্ষক হয়েও এমন ঘটনা ঘটিয়েছে যা সত্যি খুব দুঃখ ও বেদনার কারণ হিসেবে মানুষকে ব্যথিত করেছে।
জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ুয়াদের উপর অমানবিক লাঠিচার্জের চিত্র গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, যা চোখে দেখে সবাই ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করছেন এবং আঙুল তুলছেন।
নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে উদার সহিষ্ণু ভারতের কোটি কোটি মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে সংবিধানকে সামনে রেখে সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। বিভেদকামী সরকারের পতন সুনিশ্চিত করতে জনতার একতা দেখে মুগ্ধ হই।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। মহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, হিন্দু আর মুসলমান দুটি পৃথক জাতি, তাই দুটি আলাদা দেশ হওয়া দরকার। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকারও একই নীতিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভারতের সংবিধান প্রণেতারা জিন্নাহ বা সাভারকারের পথ নেননি। তাঁরা ভারতবাসীকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৭২ বছর পর সেই সংবিধানকে অস্বীকার করে মহাত্মা গান্ধী থেকে বাবাসাহেব আম্বেদকরের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্যাব-এর নামে দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সরকার। নাগরিকত্ব আইন সিএএ পাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু বিভাজনের রাজনীতির ঘৃণ্য পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বিজেপি সরকার কতটা সফল হবে তা কিন্তু সময় বলবে। কারণ, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে রক্ষা করতে দেশবাসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমরা সবাই জানি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আরএসএস তথা হিন্দু মহাসভার নেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন এবং দেশ বিভাজনের মূলেও ছিলেন তাঁরাই। আজ তাঁদের উত্তরসূরিরা আমাদের দেশপ্রেম শেখাচ্ছেন! এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!!
যারা বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা দেশের সাধারণ মানুষের কখনও কল্যাণ করতে পারে না, তা আমরা দেখছি এই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ সরকারের শাসনকালে।
চিটিংবাজ ব্যবসায়ীরা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়েছে, আর তাদেরকে ধরে আনতে বিজেপির সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কালো টাকা ফেরত আনতে পারেনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সাধারণ মানুষের একাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী এই প্রতিশ্রুতিও পূরণ করতে পারেন নি।
ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ফলে প্রতিদিন কত সাধারণ মানুষ নিঃশব্দে শেষ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। নোটবন্দী থেকে জি এস টির মতো অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপে সারা দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কোন বক্তব্য নেই। ধর্মের বড়ি খাইয়ে গোটা দেশকে আজ ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছেন তিনি।
দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চরমভাবে ব্যর্থ নরেন্দ্র মোদী সরকার । বিগত ৪৫ বছরের পরিসংখ্যানে বেকারত্ব সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষ দিন দিন দিশেহারা বোধ করছেন। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে উপযুক্ত রোজগারের সুযোগ সুবিধা থেকে অসংখ্য মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। এসবের প্রতিকারে নরেন্দ্র মোদীর সরকার নিশ্চুপ।
দেশের নাগরিকদের হাজার সমস্যার সমাধান করতে না পেরে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে গোটা বিশ্বের মানুষের সামনে সংবিধান বিরোধী নতুন নাগরিকত্ব আইন হাজির করে নরেন্দ্র মোদী সরকার কি বার্তা দিতে চাইছে তা বুঝতে হবে।
ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য মূল্যবান সম্পদ তা দেশবাসী কখনও ভুলতেই পারবে না।
দেশের জনতা নাগরিকত্ব আইন-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এই মহান ভূমিকা পালনের জন্য দেশবাসীকে কুর্নিশ জানাই।
গণতন্ত্র ও সংবিধান আজ বহু বিভেদকামী রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আরও সচেতন হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হবে, বিভেদকামী শক্তির অবসান ঘটাতে।
অনেক বছর পেরিয়ে গেল, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজও আমরা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ভারত গড়ে তুলতে পারিনি। দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সম্প্রীতির বন্ধন অগ্রাহ্য করে বেড়ে চলেছে হানাহানি।
আমাদের মধ্যে যে বিভেদের প্রাচীর তোলার অশুভ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা ব্যর্থ করতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নইলে যতই আমরা মুখে সম্প্রীতির বার্তা শোনাই না কেন, সব আয়োজন গঙ্গার ভাঙনের মতো তলিয়ে যাবে। আমরা ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিতে চাই। প্রকৃত ধর্মবোধে যারা বলীয়ান তাঁদের স্বাগত জানিয়ে সকলে মিলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে চাই।
আমরা বঞ্চনা চাই না। যে বঞ্চিত, সে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান হোক আর মুসলমান হোক, সে-ই আমাদের দুঃখের সমভাগী।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে দলিত ও সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। “লাভ জেহাদ” ও “গো রক্ষা”-র নামে অসহায় সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, যা চোখে দেখা যায় না। এই সব দৃশ্য আদি প্রকৃত ভারতবাসীদের চোখে জল আনছে।
বিভেদকামী শক্তি বিভাজন, জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে ঘৃণা, অবজ্ঞা পোষণ করছে তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। বিভেদকামী নীতির অশুভ প্রয়াস বন্ধ করতেই হবে। মুসলমানদের শত্রু বানানোর প্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে জনগণের মধ্যে একতা থাকা জরুরি। হিন্দু সম্প্রদায়ের উদার মানুষজন কিন্তু সর্বদা ভারতের কল্যাণে এবং সংবিধান রক্ষা করতে মুসলমানদের আগলে রেখেছেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী দিনেও ভারতকে সঠিক পথ দেখাবে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ভারতের শুভবুদ্ধির মানুষেরা এগিয়ে আসছেন। আমরা কখনোই যেন ভুলে না যাই, মিশ্র সংস্কৃতিই আমাদের অর্জিত বৈভব, তা আমরা রক্ষা করবই।