Tue. Jun 10th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
খােলাবাজার২৪,শনিবার,১৮জানুয়ারি,২০২০ঃ হীরে, চুনি, পান্নার প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখন যতটা, আগে ছিল আরও তীব্র। মূলত ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণেই কিছু কিছু রত্নের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ‘অভিশপ্ত’ শব্দটি। এই কথিত অভিশাপ নিয়েই তৈরি হয়ে গেছে মিথ বা পৌরণিক কাহিনী। ‘অভিশপ্ত’খ্যাত রত্নগুলোর প্রধান খুঁত—এগুলো নাকি সব মালিকের জীবনে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এমন কিছু কুখ্যাত রত্নের পেছনের ইতিহাস অনেকাংশেই রঙ চড়ানো। আবার কাকতালীয় বিভিন্ন ঘটনাকে নানা রত্নের সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়ানোও হয়েছে কখনো। এভাবেই তৈরি হয়েছে অভিশাপের গল্প।

আসুন, জেনে নেওয়া যাক কিছু বিখ্যাত ‘অভিশপ্ত’ রত্নের বিচিত্র কাহিনি।

নীল হীরক খণ্ড
অভিশপ্ত রত্নের তালিকার শীর্ষ স্থানটি হীরক খণ্ড। ফরাসি বণিক জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট ত্রাভেনিয়ে নীল রঙের হীরেটি  ভারত থেকে কিনেছিলেন। এটি ১৬৬৮ সালের কিছু আগের ঘটনা। কথিত আছে, ত্রাভেনিয়ে নাকি হোপ ডায়মন্ড কেনার কিছুদিন পর মারা যান। কিন্তু আদতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ৮০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন ত্রাভেনিয়ে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়ে আরও অনেক রত্ন কিনেছিলেন এই ব্যবসায়ী।

ফরাসি রাজপরিবারে এই দুর্লভ হীরেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ত্রাভেনিয়ে। ফরাসি বিপ্লবের আগপর্যন্ত এটি ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজপুরুষের মাথার মুকুটে শোভা পেয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সজুড়ে লুটতরাজ হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বরে হীরেটি হারিয়ে যায়।

১৮১২ সালে লন্ডনের ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল এলিয়াসন ফের প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন এই হীরে। তবে ততদিনে নতুন করে কেটে এর জেল্লা আরও বাড়ানো হয়েছে। কয়েক হাত ঘুরে শেষে এটি কিনে নিয়েছিলেন লন্ডনের রত্ন সংগ্রাহক ও ব্যাংকার হেনরি ফিলিপ হোপ। সেই থেকেই এই দুর্লভ হীরের নাম হয়ে যায় ‘হোপ ডায়মন্ড’।

এভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিন হোপ ডায়মন্ড কিনে নিজের জীবনে ঝড় বয়ে এনেছিলেন। তার নিজের মৃত্যু হয়েছিল করুণভাবে।

হোপ পরিবারের দখলে দীর্ঘদিন থাকার পর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি কিনে নিয়েছিলেন পিয়েরে কারতিয়ে। এরপর মার্কিন ধনকুবের এভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিনের স্বামী এডওয়ার্ড বিলে ম্যাকলিন হীরকখণ্ডটি কিনে তাকে উপহার দিয়েছিলেন।

ম্যাকলিন এটি কিনেছিলেন ১৯১১ সালের জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে। এর দাম ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ডলার; ২০১৯ সালের হিসাবে তা দাঁড়িয়েছিল ৪৯ লাখ ৩৯ হাজা ডলারে। কথিত আছে, এভালিনের কাছে হিরেটি বিক্রির জন্যই প্রথম অভিশাপের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন পিয়েরে কারতিয়ে। এতে এভালিন বেশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

তবে হোপ ডায়মন্ড এভালিনের জন্য শাপে বর হয়নি। কেনার পর থেকে এভালিনের পরিবারে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন: এভালিনের এক ছেলে মারা যান গাড়ি দুর্ঘটনায়, তার স্বামী পালিয়ে যান অন্য এক নারীর সঙ্গে এবং পরে তার করুণ মৃত্যু হয়। এমনকি এভালিনদের পারিবারিক মালিকানাধীন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট দেউলিয়া হয়ে যায়। এর মধ্যেই এভালিনের মেয়ে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা যান। এর ঠিক পরের বছরই মারা যান এভালিন নিজে। পরে ঋণ শোধ করতে গিয়ে বিক্রি হয়ে যায় তার সব রত্ন ও অলংকার।

বর্তমানে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা আছে হোপ ডায়মন্ড। ১৯৫৮ সালে এই হীরেটি স্মিথসোনিয়ানে দান করা হয়। প্রতিবছর লাখ লাখ দর্শনার্থী হোপ ডায়মন্ড দেখতে আসেন। জাদুঘরে স্থান পাওয়ার পর থেকে অবশ্য হোপ ডায়মন্ডের ‘অভিশাপ’ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।

কোহিনূর
এই বিশ্বখ্যাত হিরেটি এখন আছে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুকুটে। ধারণা করা হয়, ভারতের গোলকুণ্ডা খনি থেকে এর উৎপত্তি। কথিত আছে, ভারতে এক হিন্দু দেবীর প্রতিমায় চোখের মণি হিসেবে কোহিনূর ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন স্থানীয় রাজারাজড়াদের হাত ঘুরে একসময় কোহিনূর মোগল সম্রাট বাবরের হাতে আসে। পরে সম্রাট শাহজাহান নিজের ময়ূর সিংহাসনে খোদাই করে রেখেছিলেন কোহিনূরকে। শুরুতে এর ওজন ছিল ৯৮৬ ক্যারাট। পরে তা কেটে করা হয় ৮০০ ক্যারাট। ১৮৪৯ সালে তৎকালীন পাঞ্জাব প্রদেশ যখন ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে, তখন কোহিনূর সাগর পাড়ি দেয়। চলে যায় রানি ভিক্টোরিয়ার দখলে।

কথিত আছে, ভারত থেকে ব্রিটিশ মুলুকে যাওয়ার পথে বিস্তার ঝামেলায় পড়েছিল কোহিনূর বহনকারী জাহাজ। যাত্রাপথে জাহাজে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা রোগ। মরিশাসে যাত্রাবিরতির সময় কোহিনূরের দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। স্থানীয় বাসিন্দারা কোহিনূরকে তাড়াতে শেষে জাহাজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রবল ঝড়ের কবলেও পড়ে সেই জাহাজ। শেষতক ব্রিটিশ রাজপরিবারের হাতে কোহিনূর পৌঁছালেও এর আকৃতি দেখে নাকি খুশি হননি কেউ!

বলা হয়ে থাকে, এক হিন্দু দেবীর অভিশাপ আছে কোহিনূরে। অভিশাপের বৃত্তান্ত মতে, শুধু একজন নারীই এই হীরে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবেন। পুরুষেরা হাতে নিলেই হবে অঘটন। মজার বিষয় হলো, এখনো ব্রিটিশ রাজদণ্ড পাওয়া কোনো পুরুষ কোহিনূর মুকুট নেননি। বর্তমানে টাওয়ার অব লন্ডনে কোহিনূর প্রদর্শিত হয়ে থাকে।

দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’স রুবি
ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজকীয় মুকুটের ঠিক মাঝখানে একটি বড় আকারের উজ্জ্বল লাল রঙের ‘চুনি’ পাথর আছে। নানা সময় রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠানে এই রত্ন দেখা গেছে। এর নাম ‘দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’স রুবি’। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটি নাকি চুনি নয়। বরং লাল রঙের একটি বিশেষ খনিজ পদার্থ। তবে এখন এটি চুনি পাথর হিসেবেই সারা বিশ্বে বিখ্যাত।

বলা হয়ে থাকে, চতুর্দশ শতকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দখলে আসে এই রত্ন। গ্রেনাডার সুলতানের মরদেহের আশপাশ থেকে পাওয়া গিয়েছিল এই রত্ন। পরে তা ‘ব্ল্যাক প্রিন্স’ নামে খ্যাত এডওয়ার্ড অব উডস্টকের হাতে আসে। এর মধ্যেও আছে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার গল্প। বিজিতের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া এই রত্ন হাতে আসার কিছুদিনের মধ্যেই রহস্যময় এক রোগে আক্রান্ত হন ব্ল্যাক প্রিন্স। এর ৯ বছর পর মারা যান তিনি।

এই ঘটনার পরও রত্নটি নিয়ে নানা যুদ্ধ ও সংঘাত হয়েছে। সেই সব যুদ্ধে চুনি হাতে রাখা রাজপুরুষদের মৃত্যুও হয়েছে। এসব ঘটনা এই রত্নের দুর্নামের মুকুটে যুক্ত করেছে অনেক পালক।

কথিত আছে, ব্রিটিশ রাজমুকুটে যুক্ত হওয়ার পরও এই চুনি পাথরের অভিশাপ শেষ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বোমাবর্ষণের ঘটনার জন্যও অনেকে এই পাথরকে দায়ী করে থাকেন। তবে বর্তমানে অনেক দিন এ নিয়ে আর কোনো গুঞ্জন শোনা যায়নি।

ব্ল্যাক অরলভ
কালো রঙের এই হিরের গল্প জন্মলগ্ন থেকে রহস্যে মোড়া। তবে এই রহস্যের বেশ খানিকটা যে রং চড়ানো, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কোনো সন্দেহ নেই। কথিত আছে, ভারতের পদুচেরির এক মন্দিরে হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার প্রতিমায় চোখ হিসেবে খোদাই করা ছিল এই রত্ন। পরে এক সাধু তা নাকি চুরি করেছিলেন। আর সেই থেকেই অভিশাপের শুরু।

তবে রাশিয়ার দুই রাজকন্যার অলংকার হিসেবেই ‘ব্ল্যাক অরলভ’ বেশি পরিচিত। এর মধ্যে একজনের নাম ছিল নাদিয়া অরলভ। ধারণা করা হয়, এ থেকেই রত্নটির নামকরণ হয়েছিল। এই দুই রাজকন্যাই পরবর্তী সময়ে উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে শোনা যায়। পরবর্তী সময়ে জে ডব্লিউ প্যারিস নামের এক হীরে ব্যবসায়ী ব্ল্যাক অরলভ কিনে মার্কিন মুলুকে নিয়ে যান। এই ব্যবসায়ীও নাকি নিউইয়র্কের এক ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

অবশ্য হীরে বিশেষজ্ঞ ইয়ান বেলফোর তার ‘ফেমাস ডায়মন্ডস’ নামক বইয়ে লিখেছেন যে ভারতে কালো রঙের কোনো হীরে পাওয়ার তথ্য কখনোই প্রমাণিত হয়নি। এমনকি নাদিয়া অরলভ নামের কোনো রুশ রাজকন্যার অস্তিত্বও মেলেনি বলেও দাবি করেন হীরে বিশেষজ্ঞ এই লেখক।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী চার্লস এফ উইনসন এই হীরেটি কিনে নেন। পরে ব্ল্যাক অরলভের সঙ্গে শতাধিক ছোট হীরে দিয়ে একটি আকর্ষণীয় নেকলেস তৈরি করান। ১৯৬৯ সালে তা কিনে নেন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি। এরপর ব্ল্যাক অরলভের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।