
সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো। কানে দ্রিম দ্রিম শব্দ আসতে লাগলো। শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বারবার বিল্ডিং কেপে উঠছিলো। বুঝলাম, বাসার নিচে পুরো রাস্তা কেটে পুনরায় ওয়াসার বিশাল মোটা পাইপ বসানোর কাজ চলছে। যা দেড় থেকে দুই বছর আগেও বসানো হয়েছিলো। তাই মোটা ঢালাই করা রাস্তা ও রাস্তার নিচের পাইপ ভাঙা হচ্ছে। বিছানায় শুয়েই বুঝতে পারলাম বিশাল ক্ষমতা সম্পন্ন এক্সকাভেটর (যা দিয়ে বড় বড় স্থাপনা ভাঙা হয়) দিয়ে এই মাঝ রাতে আশপাশের এলাকার কয়েক হাজার ক্লান্ত নগরবাসীর ঘুম হারাম করে এই অপরিকল্পিত উন্নয়ন চলছে আদাবরের আবাসিক এলাকায়।
কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঝাঁকুনি খাচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম এই বুঝি শেষ হবে। ১০ মিনিট, ২০ মিনিট আধাঘন্টা, রাতের নিরবতা ভেঙে এক্সাভেটরের আকাশ বাতাস কাপানো শব্দ আর বিল্ডিং কাঁপাকাঁপি শেষ হয় না। ততক্ষণে যে আমাদের ভবনসহ আশপাশের কয়েকটি রাস্তার হাজারো ভবনের সকল বাসিন্দাদের ঘুম নাই হয়ে গেছে তা নিশ্চিত হয়ে গেলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। সকালে আবার অফিস। এদিকে এটাও বুঝলাম, এই দ্রিম দ্রিম শব্দ সকালের আগে আর থামবে না।
বিছানায় উঠে বসলাম। মোবাইলে চেয়ে দেখলাম রাত তখন ৩টা ১৪ মিনিট। মোবাইলে এলার্ম দেয়া রয়েছে ভোর ছয়টায়। কি করবো ভাবছি….. কিন্তু শব্দ আর বিল্ডিংয়ের ঝাঁকুনিতে মাথায় কিছুই আসছে না। এতগুলো মানুষ আমার মতো জেগে আছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো জরুরী সেবা ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে দেখি। ফোন দিলাম, ওপাশের ভদ্রলোক গভীর রাতে ভারি কন্ঠে সুন্দরভাবে সব শুনলেন। বললেন, আপনি লাইনে থাকুন আপনার কলটি আদাবর থানায় ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি। তাদেরকে সব বলুন। ফরোয়ার্ড করলেন, আমি ফের সব বললাম। তারা দুজনই তখন বলছিলেন, সরকারি উন্নয়ন কাজ স্যার। কিইবা করার আছে!! রাত ছাড়া কখন করবে? তবে শেষে বললেন, তাও স্যার আমরা বিষয়টি দেখছি কি করা যায়।
৭/৮ মিনিট অপেক্ষা করলাম। বিকট শব্দ থামছে না। বিছানা থেকে নামলাম। ভাবলাম নিচে গিয়ে অনুরোধ করবো কিনা… আবার ভাবি, সরকারি কর্মচারীরা কী আর সাধারণ নাগরিকদের গুরুত্ব দিবে। এসব ভাবতে ভাবতে চশমাটা চোখে লাগিয়ে দরজা খুলে বেলকনিতে গেলাম। গিয়ে তো আমি অবাক!! নিচে তাকিয়ে দেখি একটি বাইকে বসা দুই পুলিশ ভাই। পিছনে আরো একটি পুলিশভ্যান!!
যারা কাজ করছিলো তাদের ডেকে কিসব বলতে লাগলেন তারা। এক্সকাভেটর দিয়ে রাস্তা ভাঙার শব্দে কথোপকথন শোনা যাচ্ছিল না। আশপাশে তাকিয়ে দেখি সব বারান্দাতেই অসহায়ের মতো এই নগরীর বাসিন্দারা নির্ঘুম দাড়িয়ে আছে। আমি তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি ওয়াসার লেবাররা পুলিশের কথায় কনভেন্জড হয় কিনা। দুই পক্ষের কথা চালাচালির ২/৩ মিনিটের মাথায় হঠাৎ এক্সকাভেটর বন্ধ হলো। তখন এক পুলিশ ভাইয়ের কন্ঠ ভেসে আসলো। “এই যে দেখছেন এখন কেমন শান্ত লাগছে। আর এতক্ষণ কেমন ভয়াবহ শব্দ হচ্ছিলো। ওরকম শব্দে ঘুমানো যায়?? সারাদিন কাজ করে মানুষগুলা রাতে একটু ঘুমায়। সকালের আগে মেশিন চালু হলে সব ধরে নিয়ে যাবো।”
এই বলে বাইক আর পুলিশ ভ্যানটি ঘুরে চলে গেলো। সব মিলিয়ে আমার ফোন করা থেকে শুরু করে এক্সকাভেটর বন্ধ করে দিয়ে পুলিশের চলে যাওয়া, ১২-১৫ মিনিট!!! আমি অবাক!!!
পুলিশ ভাইয়েরা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন আশপাশের জানালা দিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে নানা কৃতজ্ঞতা সুলভ শব্দ ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন উন্নয়নের মহাসড়কে থাকা রাজধানীর অসহায় বাসিন্দারা। আর আমি বারন্দা থেকে নিজের অজান্তেই হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে মশারির ভিতরে ঢুকলাম…. ৯৯৯ এর জরুরী সেবার আনন্দে সকাল পর্যন্ত আর ঘুমই এলোনা….’
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) এভাবেই নিজের ফেসবুকে ৯৯৯ সেবা পাওয়া নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ রাকিব নামের এক সংবাদকর্মী। তার এই স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্ট করে আরো বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা।
মামুন মাহফুজ নামে এক ব্যক্তি জানান, ‘আমার বাসার কাছেও সেম অবস্থা। গানের বিকট শব্দে ঘুমাতে পারছিলাম না এলাকাবাসী।… তারপর যথারীতি ট্রিপল নাইন। পুলিশ এসে গান বন্ধ করে রাত তিনটায়।… ধরে নিয়ে যায় মদ্যপানরত কয়েকটা বেয়াদবকে।’
রুবেল শিকদার নামের এক ব্যক্তি ৯৯৯-কে ধন্যবাম জানিয়ে বলেন, এটাও উন্নয়ন বন্ধু, যেটা বন্ধ করেছে ওটাও উন্নয়ন ছিল। তবে উন্নয়ন-এর বাস্তবায়নে যারা কাজগুলো পেয়েছে, হয়তো সেই কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নের কৌশল বা টাইমিং সমস্যা। সরকারের উন্নয়ন নিশ্চয়ই জনগণকে শান্তি দিতেই। কিন্তু যাদের হাতে কাজগুলো দেওয়া তারা শান্তির বদলে জনগণের অশান্তি তৈরি করে চলছে। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ধন্যবাদ ৯৯৯।
শফিকুল সবুজ নামে আরেক ব্যক্তি জানান, ‘আমিও একবারই ফোন দিয়েছিলাম… ৫থেকে ৮ মিনিটের মধ্যে ফল পেয়েছি… ঘটনাটি ছিল রাজধানীর কামরাঙ্গিচরের খোলামোড়া এলাকায় ইজিবাইকের এক ব্যাটারি চোরকে ধরলো স্থানীয়রা..বেদম মারধর হচ্ছে… মরে যায় যায় অবস্থা.. ওই অবস্থায় আমি তাদের সামনে গিয়ে বলব আইননিজের হাতে তুলে নিবেন না… এমন অবস্থাও নেই.. বলে উল্টো আমার মার খেতে হবে। তখন ৯৯৯ এ ফোন দিলাম ওপাশ থেকে একজন ঘটনা শুনে কামরাঙ্গিচর থানায় সংযুক্ত করলেন.. বললাম গণপিটুনিতে মারা যাচ্ছে তাড়াতাড়ি আসেন.. ফোন কেটে অপেক্ষা করছি.. কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ আসলো.. শান্তি এতুটুকুই একজনের জীবন বাঁচলো.. মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম পুলিশ ভাইদের।’
অনেকেই বলেন, ৯৯৯ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার গল্পগুলোও এমনই সুখকর।
তবে, একজন লেখেন, তিনি দুবার ৯৯৯-এ ফোন করেও কোনো সাড়া পাননি। তবে তার কথার উত্তরে জয়ন্ত কর্মকার নামে একজন জানান, তিনি ৩ বার ফোন করে সহায়তা চেয়ে ৩ বারই কাঙ্খিত ফল পেয়েছেন।
একজন সন্দেহ প্রকাশ করে স্ট্যাটাসদাতা সংবাদকর্মী মাহমুদ রাকিবকে প্রশ্ন করেন, তার সাংবাদিক পরিচয়টি তিনি দিয়েছিলেন কিনা। উত্তরে মাহমুদ রাকিব বলেন, ৯৯৯-এ কথা বলার সময় তিনি নিজের পেশাগত পরিচয় দেননি।