খােলাবাজার২৪, মঙ্গলবার ১১ আগস্ট, ২০২০: ‘নভেল করোনা ভাইরাস’-যার দাপ্তরিক নাম SARS-CoV2 পুরো নাম Sever Acute Respiratory Syndrome Corona Virus2-যার বাংলা অর্থ শ^াসতন্ত্রের চরম গুরত্বর সংকট সৃষ্টিকারী করোন ভাইরাস-২। ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ICTV-International Committee on taxonomy of Virus-এই নাম দেয়ার আগে পর্যন্ত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ চীনের রির্পোট প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে এটি ‘নভেল করোনা ভাইরাস’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাস জনিত রোগের নাম দিয়েছেন Covid 19. ২০১৯ সালের ভাইরাসজনিত রোগ। করোনা ভাইরাস এর ইংরেজী সাইটে ঢুকে হুকুম-এ চাপ দিলে Novel Corona Virus এর বাংলা আসতেছে ‘উপন্যাস করোনা ভাইরাস’। সত্যি সত্যিই নভেল করোনা ভাইরাস উপন্যাসের চেয়েও অনেক বড় কিছু। মহামারী এই করোনা ভাইরাস বিশ^ব্যাপী যে তান্ডব চালাচ্ছে-তা উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা, কল্পকাহিনী, রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। অতীতের ভাইরাসগুলোকেও হার মানিয়েছে। কেননা, অতীতে ভাইরাসগুলো বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত ছিল না। যেমন: পশ্চিমা বিশে^ ২০০২-০৩ সালের সার্স ভাইরাস ও ২০০৯-১০ সালের সোয়াইন ফ্লু, মধ্যপ্রাচ্যে ২০১২ সালে মার্চ ভাইরাস, পশ্চিম আফ্রিকায় ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস, ল্যাটিন আমেরিকায় ২০১৫ সালে জিকা ভাইরাস বিস্তৃত ছিল। আর এবার করোনা ভাইরাস চীন থেকে শুরু এরপর বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত। মহামারী এই ভাইরাসের নেই কোন নির্দিষ্ট সীমানা। জাত-পাত, ধর্ম, রাজা-রানী, শাসক-প্রশাসক, মন্ত্রী-এমপি, মালিক-শ্রমিক, ফুটপাত, টোকাই, ফকির-আমীর কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। কৃষ্টি-কালচার, ধর্মপালন, খেলাধূলা, মুভি বা উৎসব সব বন্ধ করে দিয়েছে এই ভাইরাস। নিজের ঘরের বাহিরে যাওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধতা করে দিয়েছে এই ভাইরাস। দোকান, হোটেল, রেঁস্তোরা, বিপনী বিতান, গবেষণা, শিক্ষা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই যেন সীমাবদ্ধতার আবদ্ধে আবদ্ধ। নেই কোন হ্যান্ডশেক, সম্প্রীতি, কোলাকুলি-বন্ধ সব বন্ধ। আর কেউ মারা গেলে বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, পড়শী-স্বজন কেউ পাশে থাকছেন না-অজানা আতংকে বা ভয়ে। যে সব শাসকরা শোষণ করতেন আর বড় বড় বুলি আওড়াতেন বা ফানুস ঝাড়তেন তারা স্তম্ভিত। রোবট, অনুবীক্ষণিক যন্ত্র, অনু-পরমানু অস্ত্র কোন কিছুই আজ কাজে লাগছে না। এখনো পর্যন্ত গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কোন ঔষুধ বের হয় নি। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেও নিষ্কৃতি মিলছে না, মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে হাত গুটিয়ে স্তব্ধ। অফিস-আদালত, শিল্প-কল কারখানা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সব কিছু হাত গুটিয়ে স্থবির হওয়ার মতো অবস্থা। যেনো পাল্টে যাচ্ছে সমাজ-সভ্যতা। বিশে^র নামী-দামী সেনা-বিমান-নৌবাহিনী, বিশেষবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, গুপ্ত সংস্থা, আধুনিক সুসজ্জিত যুদ্ধজাহাজ, বোমারুবিমান, রকেট, স্যাটেলাইট সব কিছুকে ফাঁকি দিয়ে করোনা ভাইরাস যেনো মহামারী, বিধ্বংসী মৃত্যুদূত হয়ে সীমানা-বাধা মাড়িয়ে এক দেশ থেকে অন্যদেশে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিশে^র কোন কিছুই যেনো কাজে আসছে না-থামছে না করোনায় মৃত্যু। করোনা ভাইরাস যেনো বিশে^ বিভীষিকাময় আজব এক গজব।
বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত এই করোনা ভাইরাস থেকে রেহাই পাচ্ছেন না বাংলাদেশও। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে ০৮ মার্চ ’২০ আর প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ ’২০। এরপর থেকে যেনো নতুন সংক্রমণ আর মৃত্যু বেড়েই চলছে। মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আসে এবং সংক্রমণ শুরু হয়। বিমানবন্দরের চেকপোস্টে অসর্তকতার কারণে এটা হয়ে থাকে। প্রথমে নিজে, এরপর পরিবার, তারপর সমাজ আর এখন তো পুরো দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ। সবজেলাগুলোতেই করোনা ভাইরাস দিন দিন নতুন নতুন সংক্রমণ হচ্ছে এবং লোকজন মারা যাচ্ছে। বর্তমানে বিশে^র অন্যান্য দেশে সংক্রমণ কমে আসলেও বা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেও আমাদের দেশে এখনো তা হয় নাই। দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৮ মার্চ ’২০ প্রথম একজন মৃত্যুর পর যেনো সবারই টনক নড়লো। এর সপ্তাহ খানেক পরে ২৫ মার্চ’২০ সরকারী নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৬ মাসের জন্য ২ টি শর্তে মুক্তি দেয়া হলো-জনগণের এতে আরো টনক নড়লো এবং বিস্মিত হলো যে, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর সুচিকিৎসার জন্য উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করলে-জামিন দেওয়া হয় নাই বরং আবেদনই বাতিল করা হয় অথচ করোনাকালীন সময়ের শুরুতে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হলো। তাই করোনর প্রারম্ভেই লোকজন বাড়তি চিন্তা-ভাবনা করতে থাকলো। এরই মধ্যে সরকার করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে পরের দিন থেকেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর এই ছুটি একের পর এক বাড়ানো হলো এবং হচ্ছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের ঢিলেঢালার কারণে মানুষ যেনো সাধারণ ছুটি পেয়ে গাট্টি বেঁধে ঈদের মতো যানবাহনে ঠাসাঠাসি করে বাড়ি যায়। মোবাইল কোম্পানির দেয়া তথ্যমতে ১ কোাটি ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। প্রথম পর্বের সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল শেষ হলে সরকার সাধারণ ছুটি আবার বাড়ায় ও পরবর্তীতে বাড়াতেই থাকে এবং যানবাহন বন্ধ থাকে। কিন্তু সাধারণ ছুটি বাড়লেও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলার ঘোষণা দেয়ার মানুষ আবার সেই স্রোতের মতই যে যা পায় তাতে করে আসতে থাকে; এমন কি পায়ে হেটে-সন্তান কোলে-গাট্টি মাথায় নিয়ে দলবেধে আসতে থাকে। সামাজিক দুরত্ব মানা তো হয়েই না বরং চাপাচাপি-ঠাসাঠাসি-ঁেঘষাঘেঁষিভাবে লোকজন আসতে থাকে। বাঁধা ঠেলে ঢাকায় আসতে থাকে। আর এই আসা যাওয়ার ফলে করোনা ভাইরাস প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত চলে গেলো। পরবর্তীতে সীমিত আকারে বিধি মেনে যানবাহন চলাচল শুরু হলো, আফিস খোলা হলো, শপিংমল-র্মাকেট-বাজার খোলা হলো-করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুও বেড়ে গেলো । আজ পর্যন্ত দেশে তা অব্যাহত। সংক্রমনের দিক থেকে বাংলাদেশ ইতালিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ৭ আগস্ট ‘২০-এর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন বুলেটিন সুত্রমতে, দেশে ঐ দিন পর্যন্ত মোট করোনা ভাইরাস সনাক্ত রোগীর সংখ্যা ০২ লাখ ৫২ হাজার ৫৯২ জন, মৃত্যু ৩,৩৩৩ জন এবং সুস্থ্য হয়েছেন ০১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৮৪ জন। সংক্রমন আর মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতায় জনগণের ভাবনাশ্রিত যে, সাধারণ ছুটি ঘোষণা দিয়ে জনগণকে ঘরে রাখা ও সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে এখানে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনেকটাই ব্যর্থ।
পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে-বিশে^ ১০০ কোটির বেশী লোক চরম দরিদ্র্যতায় যাবে। এডিবি আশংকা করেছে, বিশে^ ২৪ কোটি ২০ লাখ লোক চাকরি হারাতে পারে। বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়বে। বাংলাদেশেও হয়তো প্রভাব পড়বে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে এরই মধ্যে বহু পরিবার ঢাকা শহরে বাসা-বাড়ী ছেড়ে দিয়ে গ্রামে যাচ্ছন। অনেকেই আবার পরিবার গ্রামে সেটেল করে একা মেসে উঠে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। ঢাকা শহরে টু-লেটের পরিমান কয়েকগুন বেড়ে গেছে। জনগণ এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহেলার নজরে না দেখে সুনজর কামনা করছেন। ভবিতব্য বৈশি^ক মন্দায় বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই খাদ্যশস্য উৎপাদন বরাবরভাবে ভালো হওয়ায় এই সংকট কাটিয়ে উঠা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষের অবশ্যই কৃষি বা কৃষকের প্রতি সুনজর দিতে হবে-গাফলতি হলে মন্দার প্রভাব প্রকট হতে পারে। এরপরেও প্রয়োজন-সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে বিলি-বন্টন ও বিপনন ; যাতে অন্ত:দেশীয় ও অন্ত:অঞ্চলীয় সাপ্লাই চেইন ঠিক থাকে। অফিস, যানবাহন, শিল্প ও কলকারখানাতে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যবিধি মানসম্মত উপযোগী করে চালু করা ও চলমান রাখা। দ্রুত জনগণের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও চিকিৎসার ক্রমোন্নতিসাধন করা-কেননা, অন্যান্যদের সাথে সরকারী দলেরই অনেকেই স্বাস্থ্যবিভাগের সমালোচনা করেছেন ; এতেই বোঝা যায়-স্বাস্থ্য বিভাগ কি অবস্থায় আছে ? এরপরেও দেশেই উৎপাদিত হোক আর আমদানি করেই হোক (যেটা সহজলভ্য ও ভালো) দ্রুত কিট এর ব্যবস্থা করে দ্রুত পরীক্ষা করা হলে এতে দ্রুত সংক্রমিতদের চিহ্নিত করে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে অনেকাংশেই কমে আসবে। সেই সাথে করোনাকালীন এই সময়ে অন্যান্য রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। পাঠককুল, আর একটি বিষয়ে নজর দিলে হয়তো ভবিষ্যতে আরো ভালো হবে-তা হলো স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণায় আরো বেশী অর্থ বিনয়োগ বা ব্যয় করলে এবং গবেষকদের আরো মর্যাদা বৃদ্ধির দিকে এবং সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিলে উল্লেখিত খাতগুলোর উত্তরোত্তর উন্নতির মাধ্যমেই মানুষ, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্র ভালো ও নিরাপদে থাকতে সহায়ক হবে।
করোনা পরিস্থিতি এখনো দেশে যে অবস্থায় আছে দ্রুত কাটিয়ে উঠার জন্য সরকারী দল, বিরোধী দল, প্রশাসন, জনগণ সবাইকে একযোগে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের যথাযথভাবে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপেই এগুতো হবে-তা না হলে বা ঢিলেঢালা হলে সমূহ ক্ষতির আশংকা থেকেই যায় এবং সর্বোপরি সবার আগে জনগণকে স্বাথ্যবিধি মেনে চলা ও করোনায় করণীয়তা সঠিক ও নিয়মিতভাবে পালন করতে হবে। জনগণের অসাবধানতা বা অসচেতন না হওয়ায় ভালো। অসাবধানতা বা অসচেতনতায় ক্ষতি জনগণেরই। জনগণকেই যে কোন পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে নিজেদের সুরক্ষা, নিজেদের অধিকার নিজেদেরই করে নিতে হবে। প্রয়োজনে যাচাই-বাছাই করে তাদের পাশে সহায়ক শক্তি বেছে নিবেন তারাই(জনগণ) কিংবা সেই সহায়ক শক্তির সাথে একাত্মা হয়ে মিশে কাজ করবেন জনগণই। সচেতন ও অধিকার সম্বলিত হয়ে জনগণকে সফল হতেই হবে। দিনের পর দিন অসচেতনতার কারণে জনগণ ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে অনিরাপদের দিকে যেয়ে বা অধিকার হারিয়ে একদিন হয়তো শোকেজের শোপিচের মতো হতে পারে। তাই জনগণকেই সাধবান হতে হবে, সচেতন হতে হবে, নিজেদের অধিকারের নিয়ন্তা নিজেদেরই করে নিতে হবে-তাদের (জনগণের) অধিকারের জন্য সহায়ক শক্তির সাথে মিশে ঐক্যবদ্ধতায় দ্রুত সুফল আসবে। চেষ্টায় অবিরত থাকলে সফলতা আসবেই। তাই বলা যায়- ‘‘মহামারী ভাইরাস করোনায়-থেকো না কেউ অসচেতনতায়, অসচেতনতায় অধিকার গহ্বরে হারায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলো-সচেতন হও, হও অধিকার বলে বলীয়ান, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তুলো ঐক্যতান, করতেই হবে সফলতা দৃশ্যমান।’’
লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-সাংবাদিক ও কলামিস্ট।