Sun. Apr 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

শহীদ সেলিম-দেলোয়ার দিবস ও মৃত্যুঞ্জয়ী ড. আবদুল ওয়াদুদ

২৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেলিম- দেলোয়ার দিবস। ১৯৮৪ সালের এইদিনে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ সংহতি প্রকাশ করে যোগ দিয়েছিলেন। মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি কার্জন হলের পাশ দিয়ে ফুলবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে বিকেল চারটার দিকে পুলিশের একটি ট্রাক পিছন দিক থেকে অতর্কিতে মিছিলের উপর উঠিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে ঘটনাস্থলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বাউফলের মোহাম্মদ ইব্রাহিম সেলিম এবং ভাণ্ডারিয়ার কাজী দেলোয়ার হোসেন নিহত হয়। আকস্মিক এ পৈশাচিক ঘটনায় আহত হয় ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী; পিচঢালা রাজপথ হয় রক্তে রঞ্জিত। পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডে ফুঁসে উঠে সারা দেশ, প্রকম্পিত হয় ঢাকার রাজপথ। আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। দেশব্যাপী গড়ে ওঠে দুর্বার আন্দোলন- যা পরবর্তীতে স্বৈরাচারের পতনকে ত্বরান্বিত করে। শহীদ কাজী দেলোয়ার হোসেনের পরিবারকে সান্তনা ও সমবেদনা জানাতে ঘটনার দুইদিন পরই ভান্ডারিয়াতে ছুটে গিয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দিয়ে ছাত্র হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল নেতা-কর্মীরা নিহত ও আহত নেতাকর্মীদের নিয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় থাকা একজন ছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ। প্রয়াত ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামান বাদল এবং জাকারিয়া চৌধুরী কাঁধে করে আব্দুল ওয়াদুদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় একমাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল ওয়াদুদ। তিনি একজন মৃত্যুঞ্জয়ী সাবেক ছাত্রনেতা; যিনি বর্তমানে শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদের সভাপতি। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রিধারী, ফিকামলি তত্ত্বের জনক ডক্টর আবদুল ওয়াদুদ একজন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ক্রীড়া সংগঠক, ফিজিক্যাল ফিটনেস ও ওয়াইল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞ। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ এর প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের একনিষ্ঠ ভক্ত; জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য রাজপথের এক লড়াকু সৈনিক।

শহীদ কাজী দেলোয়ার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ২৩১ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র শহীদ কাজী দেলোয়ার ও ড. আব্দুল ওয়াদুদ ছিলেন রুমমেট। পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার উত্তর পইকখলি গ্রামে ছিল কাজী দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি; আর আব্দুল ওয়াদুদের বাড়ি একই থানার উত্তর শিয়ালকাঠি গ্রামে। দু’টি গ্রামের মাঝে দূরত্ব মাত্র দশ থেকে পনেরো মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। তারা দু’জনই ছিলেন ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী; কলেজটি তখন জেলার একটি ভালো মানের বেসরকারি কলেজ হিসাবে সুপরিচিত ছিল। কলেজ জীবনে কাজী দেলোয়ার ছিলেন ডক্টর আব্দুল ওয়াদুদ এর বাবার সরাসরি ছাত্র। আবদুল ওয়াদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভান্ডারিয়া থেকে ঢাকা আসার সময় ওয়াদুদের বাবা, ভাণ্ডারিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, প্রয়াত আবদুল হালিম উকিল, তার প্রিয় ছাত্র কাজী দেলোয়ারকে দু’লাইনের একটা চিঠি লিখেছিলেন- “স্নেহের দেলোয়ার, ওয়াদুদকে পাঠালাম। দেখে শুনে রেখো। ইতি, তোমার স্যার, আব্দুল হালিম উকিল।”
ওয়াদুদ ঢাকায় আসার পর দেলোয়ার তাকে নিজের রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নিজের আপন ভাইয়ের মতোই আগলে রাখতেন তিনি ঢাকায় নতুন আসা ওয়াদুদকে; উৎসাহ যোগাতেন লেখাপড়া ও স্বচ্ছ ছাত্র রাজনীতিতে।
রুমমেট কাজী দেলোয়ার এর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ওয়াদুদ ঢাকাতে অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েন। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে রুমে ফেরার পর তাঁর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন আসে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সহযোদ্ধা ইব্রাহিম সেলিম ও রকাজী দেলোয়ার হোসেন তাদের জীবন দিয়েছেন তা সফল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকার সংকল্প ওয়াদুদের মধ্যে আরও দৃঢ় হয়। ছাত্র রাজনীতিতে ওয়াদুদ আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেন। মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি আব্দুল ওয়াদুদ ব্ল্যাক বেল্ট নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অকুতোভয় ছাত্রনেতা আব্দুল ওয়াদুদ তার দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে ছাত্রলীগের ও ছাত্র সংগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের আপোসহীন এক লড়াকু সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আবদুল ওয়াদুদ।

১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করায় অন্য সংগঠনসমূহের রোষানলের কারণে কিছুদিনের জন্য ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। সেই দুঃসময়ে আব্দুল ওয়াদুদ, মনিরুজ্জামান বাদল, মমতাজউদ্দীন মেহেদী, মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওসার এর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ আবার ক্যাম্পাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বিষয়টি নিয়ে তখন খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে ছাত্রলীগের বিষয়টি তখন মনিটরিং করতেন। দেশের প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অবিচল আস্থা, রাজপথের সহযোদ্ধা সেলিম ও দেলোয়ারের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনা ওয়াদুদকে সবসময়ই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায়।

তাই প্রিয় সহযোদ্ধাদেরকে হারানোর ব্যথা বুকে ধারণ করে ওয়াদুদ ছাত্র রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় থাকাকে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে এগিয়ে গেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে আবদুল ওয়াদুূদ রাজপথে, আন্দোলন সংগ্রামে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন দলের একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে। ছাত্রলীগের দুঃসময়ে কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অনেকবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন আবদুল ওয়াদুদ। বঙ্গবন্ধু ভবন পাহাড়া দিতে গিয়ে ফ্রিডম পার্টির আক্রমণ ও গুলির সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আবদুল ওয়াদুদ মেধাবীদের রাজনীতিতে আনতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের সহযোদ্ধা সেলিম ও দেলোয়ার এর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তাদের আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে অম্লান রাখতে, সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আপোষহীন আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তিনি গড়ে তুলেছেন শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ। প্রতিবছর এ সংগঠনটির পক্ষ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ২৮ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালন হয় সেই ১৯৮৫ সাল থেকেই।
দিবসটিতে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা বাণী প্রদান করে থাকেন। ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী সংগঠন শহীদবেদীতে সকালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে থাকে। শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ বিকেলে আলোচনা সভা ও দোয়ার আয়োজন করে থাকে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনেককেই আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করে তাদের সেই রক্তমাখা স্মৃতির কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রতিবছর বিশেষ অতিথি হিসেবে এ আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকেন।
ড.আবদুল ওয়াদুদ এর উদ্যোগে, রাজপথের সহযোদ্ধাদের নামে, প্রতিষ্ঠিত-
“শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ” এর কর্মকাণ্ড এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের দুঃসহ বেদনাবিধুর স্মৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়; মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার পুনরুদ্ধারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও আপোষহীন সংগ্রামের কথা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য ও উন্নয়নগাঁথা যাতে কোন অপশক্তি ম্লান করতে না পারে সেই লক্ষ্যে উন্নয়নের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়তে শহিদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বার্তা সম্বলিত লিফলেট দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সাধারণ মানুষের মাঝে বিলি করা এবং দুঃস্থ অসহায়দেরকে সাহায্য সহযোগিতা করার এক ব্রত আবদুল ওয়াদুদ পালন করে চলেছেন। বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েও ড.আব্দুল ওয়াদুদ তার সহযোদ্ধাদের কখনও ভুলে যাননি। দলের প্রতি ড. আবদুল ওয়াদুদ এর ভালোবাসা ও আনুগত্য সত্যিই এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
[৯০ এর ছাত্র-গণ আন্দোলনের
ইতিহাস পর্যালোচনা ও ড. আব্দুল ওয়াদুদ এর অটোবায়োগ্রাফি অবলম্বনে লেখা]
লেখক:
প্রফেসর ডঃ শামসুদ্দীন ইলিয়াস,
মহাসচিব, বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি;
সহ-সভাপতি শহীদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ।