খোলাবাজার অনলাইন ডেস্ক : সিটে বসবাস, ভোটের অধিকার নেই, মৌলিক অধিকার নেই, পরিসংখ্যানেও নেইÑ কয়েক বছর আগেও এমন চিত্র ছিল পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলে। ২০১৫ সালের ৩১শে জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে যুক্ত হয় ৩৬টি ছিটমহলের ১১ হাজার ৯৩২ দশমিক ৭৮ একর জমি। রাষ্ট্রহীনতার ইতিবৃত্ত থেকে মুক্তি পায় সিটমহলে বাস করা প্রায় ১৯ হাজার বাসিন্দা।
মাত্র ৮ বছরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের জীবনযাত্রা। সরকার এসব বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারের গৃহীত বহুমুখী উদ্যোগের ফলে এখানকার অবহেলিত মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান।
২০১৫ সালের পূর্বে বিলুপ্ত ছিটমহলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। নাগরিকত্ব না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পড়াশোনা করত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে সিটমহলে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম। এখন সেই অবস্থা নেই। সরকার ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলসমূহে ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি মহাবিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা স্থাপন করেছে। এর ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও অনেক ভালো। অনেক শিক্ষার্থীকে স্কুলে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সাইকেলও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও সিটমহলের মানুষ হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। বিনা চিকিৎসায় অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার এখানে ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন শতশত মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছেন।
গত কয়েক বছরে বিলুপ্ত সিটমহলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ইতোমধ্যে ছিটমহলসমূহে ১০২ কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়েছে। রাস্তা পাকাকরণের পাশাপাশি ১০টি ব্রিজ-কালভার্টও নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের যাতায়াতে ভোগান্তি লাঘব হয়েছে। এ ছাড়া সরকার এখানে ১১টি মসজিদ, ৪টি মন্দির, ৫টি বাজার, ১টি কবরস্থান এবং ২টি নদীর ঘাটলা নির্মাণ করেছে।
যে সিটমহলে হারিকেন কিংবা কুপি ছাড়া আলো জ্বালানোর কথা চিন্তাও করা যেত না, সেই বিলুপ্ত সিটমহলে এখন বিদ্যুৎ এসেছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃক ২৩৮ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করার পাশাপাশি ৮ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাউলাগঞ্জে ১টি সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে মোট ৩৪৯টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া লেগেছে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে অত্যাধুনিক ডিজিটাল সার্ভিস ইমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (ডি-সেট) সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ডি-সেট সেন্টার থেকে স্থানীয় জনগণ ডিজিটাল সেবা পাচ্ছেন। ডি-সেট সেন্টার থেকে অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন।
বিলুপ্ত সিটমহলে ভূমি ব্যবস্থাপনায়ও এসেছে শৃঙ্খলা। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ১লা এপ্রিল থেকে জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে ফাইনাল খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়েছে।
উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলের আর্থসামাজিক অবস্থা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি-সহ আর্থসামাজিক সব ক্ষেত্রে এখানে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হওয়ায় স্থানীয় জনগণ উচ্ছ্বসিত। দৃশ্যমান উন্নয়ন ও জনগণের উচ্ছ্বাস বলে দেয়, পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহল এখন বদলে যাওয়া এক জনপদ। (পিআইডি ফিচার)
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর