খোলাবাজার অনলাইন ডেস্ক : সিভিল সার্ভিস হলো রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার স্থায়ী কাঠামো। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও সিভিল সার্ভিস একে অপরের পরিপূরক। একটিকে ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সিভিল সার্ভিস সরকারের অনির্বাচিত অংশ। সিভিল সার্ভিসকে শাসন ব্যবস্থার খুঁটি হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। যাঁরা সিভিল সার্ভিসে চাকরি করেন, তাঁদের বলা হয় সিভিল সার্ভেন্ট বা সুশীল সেবক। সিভিল সার্ভেন্টগণ আবার ‘আমলা’ নামেও পরিচিত। বাংলা একাডেমির অভিধানে আমলার দুটি অর্থ আছে। একটির অর্থ পদস্থ সরকারি কর্মচারী, অন্যটির অর্থ আমলকী। আমলকী ভেষজগুণসম্পন্ন ফল। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় যেমন আমলকীর প্রয়োজন, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নেও আমলাদের প্রয়োজন।
এ অঞ্চলের সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস অনেক পুরাতন। অনেকেই ব্রিটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে আধুনিক সিভিল সার্ভিসের আঁতুড়ঘর মনে করেন। এটি মনে করা খুবই স্বাভাবিক। কারণ ভারত উপমহাদেশে কাঠামোভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ছিল বিশ্বের অন্যতম বনেদি সিভিল সার্ভিস। ব্রিটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয় ১৬০৮ সালে। ১৬০৮ সাল থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসের নাম ছিল মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিস। এই সিভিল সার্ভিসকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। ১৬০৮ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসকে প্রথম পর্বের মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মূলত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই ব্রিটিশ-ভারতে মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০৮ সালে ভারতে প্রথম ব্যাবসাকেন্দ্র স্থাপন করে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও এটি বিশ্বের অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়মিত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী ছিল। কোম্পানির বেসামরিক বা বাণিজ্যিক কর্মচারীদের সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কর্মচারীদের থেকে আলাদা করার জন্য তাদের বলা হতো সিভিলিয়ান। আর তাদের সার্ভিসকে বলা হতো সিভিল সার্ভিস। কোম্পানির কর্মচারীগণ ১৬০৮ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত শুধু বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই কোম্পানির এ সময়ের সিভিল কর্মচারী বা সিভিলিয়ানদের বলা হতো মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভেন্টস। আর তাদের সার্ভিসের নাম ছিল মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিস।
১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসকে দ্বিতীয় পর্বের মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশির আম্রকাননে যুদ্ধজয়ের ফলে বাংলায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের অবস্থানে পরিবর্তন আসে। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত তারা বাণিজ্যিক সিভিলিয়ান থাকলেও তারা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বা প্রভাব বিস্তারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ১৭৬৫ সাল থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসকে তৃতীয় পর্বের মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ করে। এর ফলে কোম্পানির কর্মচারীরা দ্বৈত শাসকের অংশীদার হয়। ১৭৬৯ সালে তাদের মধ্য থেকে জেলা সুপারভাইজার নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন তারা ছিলেন বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক সিভিল সার্ভেন্টস।
ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সূচনাকাল মোটেই গৌরবান্বিত ছিল না। ১৬০৮ সাল থেকে ১৭৭১ সাল পর্যন্ত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পনির সিভিল সার্ভেন্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট ইত্যাদির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। ১৭৭২ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরোপুরিভাবে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করার পর প্রেক্ষাপট বদলাতে শুরু করে। তৎকালীন কয়েকজন গভর্নর জেনারেলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক সিভিল সার্ভেন্টগণ হয়ে উঠেন বিশ্বের মর্যাদাশীল সিভিল সার্ভিসের সদস্য।
১৬০৮ সাল থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিসের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ছিল ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডাইরেক্টরস। ১৭৮৪ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডাইরেক্টরস নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে বহাল থাকলেও কোর্ট অব ডাইরেক্টরস-কে বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর নিকট জবাবদিহি করতে হতো।
মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিসে যোগদানের জন্য প্রার্থীদের তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল না। ওই সময় চাকরিতে প্রবেশের সর্বনি¤œ বয়স ছিল ১৫ বছর এবং সর্বোচ্চ বয়স ছিল ১৮ বছর। মার্কেন্টাইল সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের জন্য চাকরিপ্রার্থীকে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস-এর একজন সদস্যের নিকট আবেদন করতে হতো। তারপর ওই সদস্য আবেদনপত্রটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কোম্পানির একাউন্টস কমিটিতে পাঠাতেন। একাউন্টস কমিটি আবেদনপত্র এবং প্রার্থীর যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা ইত্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক তাঁদের মতামতসহ কোর্ট অব ডাইরেক্টরস-এর নিকট ফেরত পাঠাত। তারপর কোর্ট অব ডাইরেক্টরস-এর সভায় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগদানকে বলা হতো ‘প্যাট্রোনেজ’ পদ্ধতি।
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ প্রথমে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরিতে যোগদান করতেন। ১৬০৮ থেকে ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত তাঁদের কোনো পদসোপান বা গ্রেডেশন ছিল না। ১৬৬৪ সালে সর্বপ্রথম গ্রেডেশন প্রথা চালু করা হয়। শিক্ষানবিশ পদে কিছুদিন চাকরি করার পর তারা ‘রাইটার’ পদে পদোন্নতি পেতেন। রাইটার পদে কয়েক বছর চাকরি করার পর ‘ফ্যাক্টর’ পদে পদোন্নতি প্রদান করা হতো। এরপর ‘ফ্যাক্টর’ পদ থেকে ‘মার্চেন্ট’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। মার্চেন্ট-এর পরের পদটি ছিল ‘সিনিয়র মার্চেন্ট’। এর পরের পদ ‘এজেন্ট’। বড়ো আকারের ফ্যাক্টরির দায়িত্বে থাকা কর্মচারীকে বলা হতো ‘এজেন্ট’। সবার উপরে থাকতেন চিফ এজেন্ট/প্রেসিডেন্ট/গভর্নর। এ পদটি ছিল সর্বোচ্চ পদ। প্রধান নির্বাহীর পদটি পদোন্নতির পদ ছিল না। এ পদে রাজনৈতিক অথবা বাণিজ্যিক বিবেচনায় কোর্ট অব ডাইরেক্টরস সরাসরি নিয়োগ দিতেন।
১৭৭৩ সাল থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের নাম ছিল কোভেনেন্টেড বা চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস। কোভেনেন্টেড সিভিল সার্ভিসে প্রার্থী হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় ব্রিটেনের যেকোনো ইংলিশ পাবলিক স্কুল থেকে পাশ করা। যা বাংলাদেশের বর্তমান এইচএসসি-র সমতুল্য বিবেচনা করা যেতে পারে।
মহকুমা, জেলা ও বিভাগই ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রাণ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৭৬৯ সালে ব্রিটিশ-ভারতের প্রতিটি জেলায় একজন করে ইউরোপীয় সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। ১৭৭০-এর দশকে সুপারভাইজারদের পদবি ছিল ‘রেসিডেন্ট’। ১৭৮০-এর দশকে পদবি করা হয় ‘জেলা কালেক্টর’। ১৭৮৬ সালে যোগ হয় ‘জজ-ম্যাজিস্ট্রেট’ পদবি। ১৮৩৩ সালে ‘জজ’ পদবি বাদ দিয়ে নতুন পদবি হয় ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ইউরোপীয় জেলা কালেক্টরকে একই সঙ্গে রাজস্ব, বিচার এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন। কালেক্টর ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় রকমের বিচার করতেন। ১৮৩৩ সালে জেলার বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। তখন জেলার বিচারের দায়িত্বকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিচারিক ক্ষমতা, বিচারার্থে সোপর্দ করার ক্ষমতা ইত্যাদি থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে। আর ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারের আপিল শুনানি ও দেওয়ানি বিচার করার জন্য প্রতি জেলায় একজন দেওয়ানি বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তিনি হলেন বর্তমান সময়ের জেলা ও দায়রা জজ। তবে এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন হয় ১৮৩৫ সালে।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের নাম রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)’। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারতে সর্বশেষ আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৩ সালে। এ ব্যাচের পরীক্ষার্থীরা ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে যোগদান করেন।
ব্রিটিশ ভারতে আরও কিছু সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। এগুলো হলো : পুলিশ, রেলওয়ে, ফরেস্ট্রি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পাবলিক ওয়ার্কস, মিলিটারি একাউন্টস, টেলিগ্রাফ, কৃষি, তথ্য, সিভিল সাপ্লাই প্রভৃতি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টিকালে ৮২ জন (মতান্তরে ৯২ জন) আইসিএস অফিসার পাকিস্তানে এবং ৭০০ জন আইসিএস অফিসার ভারতে যোগদান করেন। তখন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের নামকরণ করা হয় ‘ইন্ডিয়ান এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস)’। আর পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের নামকরণ হয় ‘পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস’। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের পাশাপাশি প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস ছিল। পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসকে বলা হতো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস বা ইপিসিএস। ইপিসিএস আবার দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ইপিসিএস আপার বা ক্লাস ওয়ান-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। ইপিসিএস লোয়ার বা ক্লাস টু-সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সার্কেল অফিসার। উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের ১লা অক্টোবর জেলা কালেক্টর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদবির সঙ্গে যুক্ত হয় জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ডেপুটি কালেক্টর ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ বিলুপ্ত করে নতুন নামকরণ হয় ‘সহকারী কমিশনার’।
পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার নাম ছিল সেন্ট্রাল সুপেরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা বা সিএসএস পরীক্ষা। সেন্ট্রাল সুপেরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার মোট নম্বর ছিল ১৪০০। এর মধ্যে লিখিত পরীক্ষার নম্বর ছিল ১১০০, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার নম্বর ছিল ১০০ এবং মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ছিল ২০০।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের নাম রাখা হয় ‘সুপেরিয়র পোস্টস’। পরীক্ষার নাম হয় ‘সুপেরিয়র পোস্টস এক্সামিনেশন’ বা ‘ঊর্ধ্বতন পদের নিয়োগ পরীক্ষা’। ১৯৮০ সালে সিভিল সার্ভিসের নাম হয় ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস’ বা বিসিএস। তখন পরীক্ষার নামও হয় বিসিএস পরীক্ষা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ২০৯ জন সিএসপি অফিসার বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হন। এ ছাড়াও সাবেক ইপিসিএস ও অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে আত্তীকৃত হন।
১৯৮০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের অধীন সংস্থাপন বিভাগ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসমূহকে পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুনর্গঠন) আদেশ, ১৯৮০’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করে। এ আদেশে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে ১৪টি মূল ক্যাডার ও কতিপয় সাব-ক্যাডারে বিভক্ত করা হয়। ১৯৮০ সালের ৩১শে আগস্ট সংস্থাপন বিভাগ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুনর্গঠন) আদেশ, ১৯৮০-র সংশোধনী আদেশ জারি করে। এ আদেশে ১৪টি ক্যাডার এবং সাব-ক্যাডারসমূহকে ৩০টি স্বতন্ত্র ক্যাডারে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।
১৯৯২ সালের ১৬ই মার্চ বিসিএস (সচিবালয়) ক্যাডার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০৭ সালের ১লা নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হয়। এর ফলে বিসিএস (বিচার) ক্যাডার সার্ভিস থেকে আলাদা হয়। ২০১৮ সালের ১৩ই নভেম্বর বিসিএস (অর্থনীতি) ক্যাডার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হয়। বর্তমান বিসিএস (টেলিযোগাযোগ) ক্যাডারও বিলুপ্ত। টেলিযোগাযোগ এখন বিটিসিএল নামের কোম্পানি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম ‘সুপেরিয়র পোস্টস এক্সামিনেশন’ অনুষ্ঠিত হয়। শুধু মুক্তিযোদ্ধাগণের জন্য এ পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে এ ব্যাচে ১৩১৪ জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হয়। এই ব্যাচকে বলা হয় ১৯৭৩ ব্যাচ বা মুক্তযোদ্ধা ব্যাচ।
অমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। এ ব্যাচের পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। বিভিন্ন কারণে এ ব্যাচের চাকরিতে যোগদান বিলম্বিত হয়। ১৯৭৭ সালে এ ব্যাচের কর্মকর্তাগণ যোগদান করেন। এ ব্যাচ ১৯৭৭ ব্যাচ হিসাবে পরিচিত। পরে তাদেরকে দ্বিতীয় ব্যাচ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ ব্যাচ নন-ফ্রিডম ফাইটার ব্যাচ হিসাবেও পরিচিত। ৫০০ নম্বরের লিখিত ও ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে এ ব্যাচে মোট ৫০০ জন কর্মকর্তা বাছাই করা হয়।
সুপেরিয়র পদ পরীক্ষা ১৯৭৬-এর মাধ্যমে ৩য় ব্যাচে ১৩৫ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ব্যাচের কর্মকর্তাগণ যোগদান করেন ১৯৭৯ সালে। তাই এ ব্যাচ ১৯৭৯ বা তৃতীয় ব্যাচ হিসাবে পরিচিত। ১৯৭৯-র ব্যাচকে মনে করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নিয়মিত ব্যাচ। এ ব্যাচের পরীক্ষা, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অনেকটা আইসিএস ও সিএসপিদের আদলে করার চেষ্টা করা হয়। এ ব্যাচের বাছাই পরীক্ষার মোট নম্বর ছিল ১৬০০। এর মধ্যে লিখিত ১৩০০ নম্বর, সাইকোলজিকেল টেস্ট ১০০ নম্বর এবং মৌখিক পরীক্ষা ২০০ নম্বর।
এরপর ৪র্থ ব্যাচের কর্মকর্তাগণ যোগদান করেন ১৯৮১ সালে। এ ব্যাচ ১৯৮১ ব্যাচ হিসাবেও পরিচিত। ১৯৮১ ব্যাচের লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, প্রশিক্ষণের মেয়াদ, প্রশিক্ষণের ধরন, চূড়ান্ত মেধা তালিকা তৈরির পদ্ধতিসহ সব কিছুই ১৯৭৯ ব্যাচের অনুরূপ। ১৯৮০ সালে সিভিল সার্ভিসের নাম রাখা হয় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস। তখন পরীক্ষার নাম হয়ে যায় বিসিএস পরীক্ষা। পরিবর্তিত নামে প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যাচ হলো ১৯৮২ ব্যাচ। এ ব্যাচ ৫ম ব্যাচ হিসাবেও পরিচিত। ১৯৮২ ব্যাচের লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ছিল ১৯৭৯ এবং ১৯৮১ ব্যাচের অনুরূপ।
১৯৮২ সালের ৭ই নভেম্বর থানাকে ‘মান উন্নীত থানা’ করা হয়। তখন প্রতি থানায় কোর্ট স্থাপন করা হয়। কোর্টে কর্মকর্তা পদায়নের প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মান উন্নীত থানা ম্যাজিস্ট্রেট পদে আবেদনের বয়স নির্ধারণ করা হয় সর্বনি¤œ ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫০ বছর। এ ব্যাচে ৬৫০ জন কর্মকর্তা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষাকে নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।
এছাড়া স্বাস্থ্য ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা ১৯৮৩ অনুষ্ঠিত হয়। এই ব্যাচে ১৩২৫ জন কর্মকর্তা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষাকেও নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। শুধু কৃষি ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা ১৯৮৪ অনুষ্ঠিত হয়। এ ব্যাচে ১০৮ জন কর্মকর্তা নেওয়া হয়। এ ব্যাচকে নিয়মিত বিসিএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।
বিসিএস পরীক্ষা ১৯৮৪-র মাধ্যমে সকল ক্যাডার মিলে ৭৯৫ জন কর্মকর্তা নেওয়া হয়। এ ব্যাচটি ৬ষ্ঠ ব্যাচ হিসাবে পরিচিত। এ ব্যাচে মোট ১০০০ নম্বরের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে বাংলায় ১০০ নম্বর, ইংরেজিতে ১০০ নম্বর, গণিতে ১০০ নম্বর, বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে ১০০ নম্বর, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ১০০ নম্বর, ঐচ্ছিক ৩টি বিষয়ে ৩০০ নম্বর এবং মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর। এরপর স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা ১৯৮৫ অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষাকেও নিয়মিত বিসিএস হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।
৬ষ্ঠ বিসিএস পরীক্ষা-পদ্ধতির আলোকে ৭ম, ৮ম ও ৯ম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে নিয়োগ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। আবেদেনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১০তম ব্যাচ থেকে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি বা এমসিকিউ পরীক্ষা চালু হয়। এ ছাড়া এ ব্যাচের অন্যান্য সকল বিষয় ৬ষ্ঠ ব্যাচের অনুরূপ।
১০তম থেকে ২৬তম বিসিএস পর্যন্ত মোট ছয়টি বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১২তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু পুলিশ ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষা ক্যাডার নিয়োগের জন্য ১৪তম, ১৬তম ও ২৬তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য ১৯তম (বিশেষ) বিসিএস এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের জন্য ২৩তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
২৭তম ব্যাচ থেকে নিয়োগ পরীক্ষায় পরিবর্তন আনা হয়। এ ব্যাচ থেকে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর করা হয় ১০০। এমসিকিউ পরীক্ষা অপরিবর্তিত থাকে। তবে লিখিত পরীক্ষার নম্বর ঠিক রেখে বিষয়সমূহ পুনর্বিন্যাস করা হয়। ২৭তম ব্যাচের নিয়োগ একবার চূড়ান্ত করে পরে বাতিল করা হয়। পরে আবার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ফল চূড়ান্ত করা হয়। এ কারণে ২৭তম ব্যাচের যোগদান বিলম্বিত হয়। ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার আদলে ২৮তম ও ২৯তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০তম বিসিএস-এর মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২০০। এরপর একই পদ্ধতিতে ৩১তম, ৩৩তম ও ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩২তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের নিয়োগ প্রদান করা হয়।
৩৫তম ব্যাচ থেকে পরীক্ষা-পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ২০০ নম্বর করা হয়। লিখিত পরীক্ষার পাশ নম্বর ৪৫ নম্বর থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। তাছাড়া ৩৫তম ব্যাচ থেকে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ৩৫তম বিসিএস-এর সিলেবাস এবং পরীক্ষা-পদ্ধতির আলোকে পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষাসমূহ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ৩৯তম এবং ৪২তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। উল্লেখ্য, ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে কোটা পদ্ধতি বাদ দেওয়া হয়।
বিসিএস পরীক্ষা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। যোগ্যতা প্রমাণ দিয়েই প্রার্থীদের সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করতে হয়। সিভিল সার্ভিসের মূল কাজ হলো সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকার ও সিভিল সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাগণের মধ্যে অনেকেই নন্দিত, আবার নিন্দিত কর্মকর্তার সংখ্যাও কম নয়। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সিভিল সার্ভিসকে আরও দক্ষ, জনবান্ধব ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। (নিবন্ধ)
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর