বিশেষ প্রতিনিধি: সরকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়ে থাকে রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানি করতে হয়। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা হয়। অথচ, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে আনা হয়নি টাকা।
দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অনন্ত ডেনিম’র এক’শ তিন কোটি ছেষট্টি হাজার টাকার রাজস্ব ফাঁকি। এমনটাই করেছে অনন্ত ডেনিম টেকনোলজির লিমিটেড। এবিষয়ে কাস্টমস এন্ড কমিশনারেট শুল্ক-করাদি ফাঁকি সংক্রান্ত মামলা প্রতিবেদন দাখিল করলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে বিষয়টি এখনো সুরাহ হয়নি বরং ধামাচাপায় পড়ে গেছে বিষয়টি। অনন্ত ডেনিম টেকনোলজির এমডি শরীফ জহির ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আবার নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে। কে এই ক্ষমতাধর শরীফ জহির? এনিয়ে দেশের ব্যবসায়ী মহল, কাস্টম কর্মকর্তাদের ও সিঅ্যান্ডএফ মালিকসহ আমদানি–রপ্তানিকারকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের ৩০ মে’র কাস্টমস এন্ড কমিশনারেট একটি নথি থেকে দেখা যায়, শরীফ জহিরের মালিকানাধীন অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেডের বিরুদ্ধে কর কমিশনারে মামলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বেশ কয়েকজন রাজস্ব কর্মকর্তা।
যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সাতজন কর্মকর্তা শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করে শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি উদঘাটন করেন।
সূত্র জানায়, সেসময় কাস্টম কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি চিত্র হাতেনাতে ধরে। পরে অনন্ত ডেনিমের জেনারেল ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম চৌধুরীর নিকট থেকে লিখিত ও বিবৃতি নেয়া হয়।
প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা যায়, বন্ড সুবিধায় ২৩,৪১,১৩৪ কেজি ডেনিম ফেব্রিক্স এর শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১০৮,৪৩,৩৪,৪৪৬ টাকা এবং উহার উপর প্রযোজ্য শুল্ক করাদির পরিমান ৯৯,৬২,৯২,০৪১ টাকা ও ২৯১১৪৭৫ কেজি ডাইস কেমিক্যালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১১১৪৩৫০১৯ যার বিপরীতে প্রযোজ্য শুল্ক করাদির পরিমান ৪০৬৭৪২৮৮ টাকা। মোট ১০৩,৬৯,৬৬৩২৯ টাকা (একশত তিন কোটি উনসত্তর লক্ষ্য ছেষট্টি হাজার ) অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিঃ এর নিকট আদায় যোগ্য। যা পুরো রাজস্বটাই সরকারকে ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০২২ সালে ০২ মার্চ ভারত থেকে রপ্তানি সুবিধার আওতায় আমদানি করা ডেনিম ফেব্রিকসের ট্রাক থেকে মাদকসহ অবৈধ পণ্য উদ্ধার করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। ডেনিম ফেব্রিকসের আমদানিকারক ঢাকার অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড ও ফ্যাশন ফোরাম লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। এ ঘটনায় একটি মামলা করা হয় বেনাপোল বন্দর থানায়।
কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দ্য কাস্টমস এক্ট ১৯৬৯ এর সেকশন ১৩ এর সঙ্গে পঠিতব্য বন্ড লাইসেন্সের শর্ত ও একই এক্ট এর সেকশন ৮৬, ৯৭ ও ১১৪ এর বিধান এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী দন্ডযোগ্য এবং দন্ডিত অর্থ আদায়যোগ্য। কিন্তু প্রতিবারের মতো নানান টালবাহানা করে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মূখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসের সাথে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে বের হয়ে যান এই দুর্নীতিবাজ শরীফ জহির।
কে এই শরীফ জহির?
শরীফ জহিরের বিষয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামীলীগের প্রেতাত্মা শেখ হাসিনার আস্থা বাজন শরীফ জহির জোরজবরদস্তি করে ইউসিবিএল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছে!
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের (বিজিএমইএ) সদস্য। অনন্ত গ্রুপের এমডি শরীফ জহিরের চট্টগ্রাম ইপিজেডে জেড অ্যান্ড জেড ইন্টিমেন্টস কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া আদমজী ইপিজেডে ৫টি কারখানা রয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মূখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকসহ উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের দহরম মহরম সম্পর্ক থাকলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়ার সাথেসাথেই শরীফ জহির হয়ে গেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লোক!
আরো জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা হাইকোর্টের (উচ্চ আদালত) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে দাখিল করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পানামা পেপারসে ৪৩ ও প্যারাডাইস পেপারসে ২৬ জনের নাম রয়েছে। সেই তালিকাতেও এই শরীফ জহিরের নাম রয়েছে।
এসব বিষয় জানতে শরীফ জহিরের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করার চেস্টা করলেও তিনি দেখা করেনি। তার মুঠোফোনে বারবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে তার মেইলে, হোয়াটঅ্যাপ এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।