Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
বাঁ দিকে উপুড় হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে শুভ্র এক শিশু। গায়ে ভেজা লাল শার্ট, নেভি-ব্লু হাফ প্যান্ট আর পা জোড়ায় ছোট্ট জুতা। দেখে মনে হবে ঘুমিয়ে আছে। চারপাশে খেলা করছে পবিত্র এক আভা। কিন্তু বাস্তবে এ এক ভিন্ন দৃশ্য। তার নিথর প্রাণহীন দেহের চারপাশে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তার মাথা খানিকটা ডেবে গেছে সৈকতের বালিতে। এই শিশুটিই ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া ১২ জন ইউরোপগামী অভিবাসন-প্রত্যাশীর একজন। বিশাল সমুদ্রেরও হয়তো নিজের ভেতর তাকে ধারণ করতে বুক কাঁপছিল। এজন্যই ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতে ঠেলে দিয়েছে তার দেহকে। আর শিশুটির এমন ছবিই ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘ভাসমান ধ্বংসপ্রাপ্ত মানবতা’র প্রতিচ্ছবি হিসেবে। বৃটেনের বেশির ভাগ সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম এ ছবিটিকে ঘিরে। এ খবর দিয়েছে সিএনএন ও আল-জাজিরা।

কেউ বলছেন, তাদের আশা ছিল, এ ছোট্ট ছেলেটির নিস্তেজ শরীরের ছবিটির কারণে ইউরোপগামী শরণার্থীদের স্রোত মোকাবিলার উপায় নিয়ে চলমান বিতর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বাঁক নেবে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে রাজনীতিকদের ব্যর্থতা দেখিয়ে দেবে ছবিটি। আত্ম-ব্যর্থতায় দগ্ধ হবে কিছুটা মানবিক হবেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালীরা। কিন্তু অচিরেই তারা বুঝেছেন, আশা কুহকিনী বৈ অন্য কিছু নয়। এজন্যই হয়তো প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের শিরোনাম- ‘এ ছবিগুলোও যদি ইউরোপকে পাল্টাতে না পারে, তবে কি পারবে?’।

1-2

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক নাদিম হওরি ছবিটিকে বলছেন, ‘গা ছমছমে’। আসলেই তাই। এ ছবি হয়তো অনেকদিন তাড়িয়ে বেড়াবে বিশ্বজুড়ে অসংখ্যা মানবতাবাদীকে। নাদিমের মতে, এটিই সামগ্রিক ব্যার্থতার সবচেয়ে সপষ্ট প্রতিবিম্ব। তুরস্কের বুরহান আকমান শুধু লিখেছেন, গোটা পৃথিবীর জন্য একরাশ লজ্জা। আমি ছবিটিতে শুধু মানুষ দেখছি, মানবতার ছোঁয়া দেখছি না।

লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ছেপেছে হতভাগা এ শিশুর ছবি। সেখানে ক্যাপশন আকারে মাত্র চারটি লাইন লেখা হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে ‘সামবডিজ চাইল্ড’। এতে ওই শিশুটিকে সিরিয়ান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তুরস্ক থেকে গ্রিস যাওয়ার পথে পরিবারের সঙ্গে সে ডুবে মারা গেছে। ইউরোপে প্রবেশ করতে মানবতার সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ডেইলি এক্সপ্রেস লিখেছে, ‘মানবিক এ সঙ্কটের জন্য ইইউ দায়ী’। মেট্রো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে শিশুটির ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একজন উদ্ধারকর্মী শিশুটিকে দুই হাতে কোলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। শিরোনামে বলা হয়েছে- ‘ইউরোপ তাকে বাঁচাতে পারেনি’। দ্য টাইমসেও প্রায় একই রকম ছবি ছাপা হয়েছে। এর শিরোনাম ‘ইউরোপ ডিভাইডেড’। ডেইলি মেইলও একই কাজ করেছে। এর শিরোনাম ‘ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শিকার ছোট্ট শিশু’। দ্য সানের শিরোনাম ‘জীবন এবং মৃত্যু’। ডেইলি মিররের শিরোনাম ‘অসহনীয়’। দ্য গার্ডিয়ানের শিরোনাম ‘হতাশাজনক, নিষ্ঠুরতায় ইউরোপে শরণার্থী সঙ্কট’।
দুই সন্তান ও স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে নৌকায় চড়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল কুরদি। বুধবার তুরস্ক উপকূলে এসে ডুবে যায় তাঁদের নৌকাটি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর বুধবার আবদুল্লাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার জ্ঞান ফিরে হাসপাতালের টিভিতে তিনি প্রথম ছোট ছেলে আইলানের মৃত্যুর খবর দেখেন। এরপর জানতে পারেন তাঁর স্ত্রী ও বড় ছেলেও বেঁচে নেই। মৃত্যু হয়েছে পরিবারের মোট ১২ জন সদস্যের। সব হারিয়ে আবদুল্লাহর এখন একটাই আকুতি- ‘আমাকেও সন্তানদের সাথে কবর দাও।’

রয়টার্স জানিয়েছে, বাবা আবদুল্লাহই প্রথম সংবাদমাধ্যমকে ‘তুরস্কের সৈকতে পাওয়া অজানা শিশুর লাশের’ পরিচয় জানান। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এটা তাঁর তিন বছরের ছেলে আয়লান আল কুরদি। যে জামা, যে জুতা পরে সে নিথর হয়ে বালিতে শুয়ে ছিল- মঙ্গলবার তিনি নিজ হাতে তাকে ওই পোশাক পরিয়েছিলেন। আরো জানান ওই নৌকায় তার স্ত্রী রাইহান ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে গালিপও ছিল। এরপর দিনের বিভিন্ন সময়ে মা-ছেলেসহ আরো এগারোজনের লাশ উদ্ধার করে তুরস্কের পুলিশ।

রয়টার্স জানায়, একের পর এক লাশের সন্ধান আসছিল আর উন্মাদের মতো আচরণ করছিলেন আবদুল্লাহ। এক সময় তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘আমাকেও সন্তানদের সাথে কবর দাও।’ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আবদুল্লাহ তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সিরিয়ায় নিজের যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর কোবানিতে ফিরতে চান। কাদের জন্য আর ‘নিরাপদে’ থাকার জন্য ঝুঁকি নেবেন তিনি!

উবু হয়ে তুরষ্কের সৈকতে পড়ে থাকা উজ্জ্বল লাল টি-শার্টের সাথে নীল হাফপ্যান্ট পরা আইলানের প্রাণহীন দেহ ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বে গভীর আবেগের জন্ম দিয়েছে। সারা বিশ্বের সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্যবার ছবিটি দেখেছে মানুষ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের সংবাদমাধ্যম সৈকতে উবু হয়ে পড়ে থাকা মৃত শিশুটির ছবি প্রথম পৃষ্ঠার একটি বড় অংশজুড়ে ছাপিয়েছে।

সবারই অভিমত, এ একটি ছবিই বলে দিচ্ছে ইউরোপজুড়ে অভিবাসন সংকট কতটা চরমে পৌঁছেছে। বিশ্বজুড়ে মানুষের বেদনার কারণ হয়েছে প্রাণহীন এই শিশু। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও শিশুটি বিশ্ববাসীকে অভিবাসীদের সত্যিকার অবস্থা এবং তাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। নিউইয়র্কের টাইমসের সম্পাদকীয়ের শিরোনামটি হলো- ‘জীবন দিয়ে কঠোর ইউরোপীয়দের ভবিষ্যৎ বুঝিয়ে গেছে ছোট্ট আইলান।’

এখন আইলানের এই হৃদয়বিদারক শেষ ছবিটির দর্শক, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক সবাই পীড়াদায়ক ছবিটি অন্য সবাইকে দেখাতে চান; যাতে এটা সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন তৈরি করতে পারে।