Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ : বর্ষায় গঙ্গা (পদ্মা) নদীর পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে তা বিভিন্ন শাখা নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত করে ওইসব নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা, লবণাক্ততা কমানো ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রাজবাড়ীর পাংশায় ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গঙ্গা ব্যারেজ পরিকল্পনা নামে পরিচিত এ উদ্যোগ। কিন্তু উজানের দেশ ভারত থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া না গেলে এ উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না। তাই পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভারতকে অংশীদার করে ব্যারেজটি বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। পাশাপাশি যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যারেজটিতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে, তারাও ভারতের সম্মতি ছাড়া এ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট হতে রাজি নয়। এমন পরিস্থিতিতে গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়নে অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ।

বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢল বাংলাদেশে নদীভাঙনের কারণ হয়। শাখা নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ভাঙন বৃদ্ধি পায়। সারা বছর পানিপ্রবাহ থাকলে শাখা নদীগুলোর বুকে পলি জমতে পারে না। ফলে বর্ষায় পানির প্রবাহ বাড়লেও তা নদীভাঙনের কারণ হতো না। কিন্তু উজানে পানি প্রত্যাহার করায় শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যায়। ফলে এর শাখা নদী যেমন— গড়াই, মাথাভাঙ্গা ও হিসনা নদীতে কোনো পানি থাকে না। এ কারণে এসব নদী অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব। এভাবে চলতে থাকলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ২৬টি জেলা ও ১৬৪টি উপজেলার প্রায় ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সুপেয় পানির সংকটে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিপুল ফসলি জমি। বেড়ে যাবে উত্তাপ। সার্বিকভাবে জনজীবন হবে বিপর্যস্ত।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ থেকে ১৮৫ কিলোমিটার নিচে রাজবাড়ীর পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ নামে একটি বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বর্ষায় আসা পানি সংরক্ষণ করে তা শুষ্ক মৌসুমে শাখা নদীগুলোতে প্রবাহিত করে এসব নদীর পলি হটানো ও নদীতে প্রবহমান পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু উজান থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত না হলে এ ব্যারেজ কোনো কাজে আসবে না। ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে ফারাক্কা থেকে দৈনিক ৭৮৩ কিউমেক পানি পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে কোনো কোনো সময় এ পরিমাণ পানিও পাওয়া যায় না। ২০২৬ সালে চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হবে। এর পর যদি ভারত চুক্তি নবায়ন না করে, তাহলে পদ্মায় শুষ্ক মৌসুমে পানি নিয়ে শঙ্কা বাড়বেই। ফলে ব্যারেজও কোনো কাজে আসবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নদী গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন বলেন, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি ছিল না। যে কারণে শুষ্ক মৌসুমে সেখানে পানি থাকে না। ফলে তিস্তা ব্যারেজও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ভারত যেহেতু উজানের দেশ, তাই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পানি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া উচিত।

এদিকে ব্যারেজ নির্মাণে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ অর্থ সংস্থানে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে সরকার। কিন্তু বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যারেজ নির্মাণে ভারতের অনাপত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত জানিয়েছিল, পাংশায় ব্যারেজ নির্মাণ হলে উজানে পানির চাপ বাড়বে। এতে ফারাক্কা বাঁধে পানির চাপ বাড়বে এবং বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে। তাছাড়া নদীতে পানি আটকে রাখলে নিচে পলি জমবে। এতে করে বর্ষার সময় পানির প্রবাহ কমে যাবে। কিন্তু গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দেখা গেছে, ব্যারেজের কারণে ফারাক্কা বাঁধ এলাকায় পানির উচ্চতা বাড়বে মাত্র ৪ দশমিক ৭ ইঞ্চি। আর ৬০ বছরে নদীর তলদেশে পলি জমবে মাত্র দশমিক ৭ মিটার। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ড্রেজিং করে এ পলি অপসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে বাংলাদেশের। সুতরাং ভারতের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া গঙ্গার যে শাখা নদীটি রয়েছে, সেটির পানিপ্রবাহ বাড়বে। এতে করে তারাও উপকৃত হবে।

এসব বিষয় জানিয়ে ভারতকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। আর ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সে দেশকে প্রস্তাব দেয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের পরিচালক আবদুল হাই বাকী বলেন, গঙ্গা ব্যারেজ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। তবে গঙ্গা নদীর বড় অংশের মালিকানা ভারতের। তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আমরা এখন পানি পাচ্ছি। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিপত্তি বাধবে। তাই প্রকল্পের বিষয়ে দুই দেশের যৌথ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে তা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। সাত বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে যেসব ফল আশা করা হচ্ছে, সেগুলো হলো— পদ্মা অববাহিকায় পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা, গঙ্গা ব্যারেজ, জিকে প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ১১৮টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি এফসিডি প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের ঘাটতি মোকাবেলা করা। এতে করে প্রকল্প এলাকায় বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাশাপাশি দুটি পোল্ডারের মাধ্যমে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটিতে বছরে নিট মুনাফা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্প ব্যয় উঠে আসবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের ৩৩ শতাংশ এলাকা উচ্চ লবণাক্ততা থেকে রেহাই পাবে এবং সেখানে সুন্দরীসহ নানা ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে।

গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ হলে পাংশা থেকে উজানের ১৬৫ কিলোমিটার এলাকায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর নদীগর্ভে সবসময় ২৯০ কোটি কিউমেক পানি জমা থাকবে। এতে যুক্ত হবে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য ৭৮৩ কিউমেক পানি। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত যে পরিমাণ পানি ছাড়া যাবে, তা দিয়ে পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলোর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। এ সময় দুটি ফিশ পাস, দুটি টারবাইন ও একটি নেভিগেশন লকের মাধ্যমে দৈনিক ৫৭০ কিউমেক পানি ছেড়ে দেয়া হবে। এতে করে সারা বছর পানির প্রবাহ ঠিক থাকবে। পাশাপাশি ব্যারেজের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় মাথাভাঙ্গা, হিসনা ও গড়াই নদীতেও সারা বছর পানি প্রবাহিত হবে। ফলে এসব নদীর অববাহিকার অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমবে।