খোলা বাজার২৪ ॥ মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
আন্দোলনের মুখে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর থেকে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করলেও তা বহাল রয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্ষেত্রে। আন্দোলনের কারণে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলেও ইংলিশ মিডিয়ামের তা বহাল থাকায় বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর শিক্ষক ও অভিভাবকরা। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রথম ভ্যাট ব্যবস্থা প্রচলন করেছিলেন। তবে দেশে প্রথম শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ করা হয় ২০০৬ সালে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর উপর সাড়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু। অবশ্য বাংলাদেশের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাটের আওতামুক্ত রয়েছে। পরে ২০০৯ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির উপর ভ্যাট আরোপ করা হলেও আন্দোলনের মুখে বাজেট পাস হওয়ার আগেই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের উপর উল্টো ভ্যাট বৃদ্ধি করে তা সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় দফা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেতনের উপর দশ শতাংশ এবং বাড়ি ভাড়ার উপর নয় শতাংশ ভ্যাট কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়। একইসাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টিউশন ফির উপরও দশ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়। তবে সংশ্লিষ্টদের বিরোধিতার ফলে চূড়ান্ত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়ামের টিউশন ফির উপর ভ্যাট কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সোমবার ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর উপর ভ্যাট বহাল থাকায় অসন্তুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এর আগে নানা সময়ে বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এ্যাসোসিয়েশন ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করাসহ অর্থমন্ত্রীর সাথেও বৈঠক করেছিল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, ভ্যাট আরোপের ফলে দেশে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম নিজাম উদ্দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘শিক্ষায় পণ্য না, এতে ভ্যাট থাকা উচিত না। আন্দোলনের কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বাচ্চাদের উপর থেকেও ভ্যাট চলে যাওয়া উচিত। তা না হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়বে। কারণ এতে করে যে মধ্যবিত্ত ও চাকুরীজীবীরা তাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন তারা আর ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন না। ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থা কেবল হয়ে পড়বে ধনিক শ্রেণীর।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বেকারের হার দিনদিন বাড়বে। বিদেশে আমাদের জনশক্তি রফতানি করতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে টিকে থাকার জন্য তাদের সে মানের ভাষা ও সংস্কৃতি বুঝতে হবে। সে জন্য ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষাকে সবার সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে হবে।’ কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘সরকার ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে এখানে সরকারের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই, অভিভাবকরা সম্পূর্ণ ব্যয় নিজেরা বহন করেন, এরপরও আমাদের উপর ভ্যাট বসাচ্ছে। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক।’ নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘বিষয়টি সরকারের ভেবে দেখা উচিত যে ভাংচুরের কারণে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে, তাহলে কি ৩ বছরের শিশু যে ভ্যাটই বুঝে না তারও গাড়ী ভাংতে হবে? আমরা ভাংচুরে বিশ্বাস করি না। কিন্তু জোর করে কেউ ছাড় পাবে, আর জোর না করায় কেউ পাবে না— এটা হতে পারে না। তবে অভিভাবকরা যখন ব্যয় সামলাতে না পারবে তখন দেখা যাবে এ শিশুরাও আন্দোলনে নামবে, যা কাম্য নয়। “আমাদের নৈতিক হতে হবে। কারণ বাচ্চারা এ সব বলতে পারবে না, তাদের কথাটা বলতে হবে সবার, বুঝতে হবে” যোগ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এ্যাডেক্সেল এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলাদেশে তিন শতাধিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এ সব স্কুলে দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। স্কুলের উচ্চ ব্যয়ভার বহনের পাশাপাশি ভ্যাটের কারণে তাদের ব্যয়ের ‘বোঝা’ বাড়ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার হিট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাজিয়া বেগম বলেন, ‘সরকার ইংলিশ মিডিয়ামের উপর গত অর্থবছরে ভ্যাট বাড়ানোর পর এবার বাড়াতে চেয়েছিল। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রতিবছরই ভ্যাট বাড়বে। স্কুলে পড়াতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়, তার উপর ভ্যাট দিলে একটি পরিবার চলবে কী করে?’ হিট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এডমিন অফিসার আব্দুল হক বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেক টাকা ব্যয় করতে হয় পড়াশুনার জন্য। সে জন্য বাচ্চাদের স্বার্থে যদি সরকার এ শিক্ষা খাত থেকে ভ্যাট উঠিয়ে দেয় তাহলে তাদের অভিভাবকদের উপর চাপ কমে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েরাও এখন ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হয়। কষ্ট হলেও তারা চায় তাদের সন্তান যেন ভাল পড়তে পারে। সেখানে সরকারের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে সেহেতু এ ক্ষেত্র থেকেও এটি উঠিয়ে নেওয়া উচিত।’ লালমাটিয়ার একাডেমিয়া স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে এটা ইতিবাচক। তবে ইংলিশ মিডিয়ামের ভ্যাট প্রত্যাহার না হওয়ার মানে এই যে, সরকার আন্দোলনকে ভয় পায়, যুক্তি কিংবা দাবিকে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।