Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ১৬ বৃহস্পতিবার ২০১৫ ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্টরা খুব ভালো করেই জানেন যে, দেশের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কীরূপ অরাজকতা চলছে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা যদি কোনো ঋণের জন্য দরখাস্ত করেন, তবে তাদের রাজ্যের হাতিঘোড়া মেরে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আসতে বলা হয়। অন্য দিকে, দুর্নীতিবাজেরা যদি ব্যাংকে যান তবে কর্তাব্যক্তিরা ব্যাংকের ভোল্ট খুলে সোনাদানা, টাকা পয়সা বের করে তাদের দেয়ার জন্য রাস্তায় নেমে আসেন উল্লাসনৃত্য করতে। এক দিকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার কৃষিঋণের জন্য কৃষককে জেলে যেতে হয়- অন্য দিকে পান থেকে চুন খসলে দেশের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ীদের নাজেহাল করার জন্য অর্থঋণ আদালতে নিয়ে তাদের বন্ধককৃত মূল্যবান সম্পত্তি গ্রাস করে পানির দামে লুটেরাদের দিয়ে দেয়া হয় নিলাম নামক প্রহসনের মাধ্যমে। আবার সেই দেশেই পাঁচ-ছয় কিংবা ১০ হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়া লোকজনকে জাতীয় অর্থনৈতিক বীরের মর্যাদা দেয়ার জন্য একশ্রেণীর ব্যাংকার ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকেন।
দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও অনিয়ম ইদানীংকালে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। পত্রপত্রিকা, দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ এবং সুধীসমাজ এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই সোচ্চার হচ্ছেন, ততই দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি হচ্ছে। তারা তাদের পদ-পদবি ও দুর্নীতির অধিক্ষেত্র দিন দিন শুধু বৃদ্ধি করেই যাচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি বেসরকারি ব্যাংকগুলোও বসে নেই। অনেক বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির ভয়াবহ প্রমাণ পাওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারছে না। ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের ডনদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে দেশের অর্থনীতি আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সেই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে সবাই মিলে একসাথে দেউলিয়াত্ব বরণ না করা পর্যন্ত কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না যে, আমরা আসলে কতটা ভয়াবহতার মধ্যেই রয়েছি।
দেশের সব ব্যাংকের মোট আমানত মাত্র ছয় লাখ কোটি টাকার মতো। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থ অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। সুতরাং সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার পুরোটাই হলো সাধারণ জনগণ কিংবা সরকারি আমানত। ব্যাংকগুলো এ যাবৎ যত টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, তার মধ্যে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর আমানতের ১০ শতাংশ টাকা খেলাপি হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই ৫৫ হাজার কোটি খেলাপি ঋণের ৭০ শতাংশ দায় সৃষ্টি হয়েছে গত সাত বছরে। অর্থাৎ এই সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে।
সরকারি হিসাব অনুসারে, ৫৫ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হলেও বাস্তব অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর। অনেক সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঠেকানোর জন্য অনেক অনিয়মিত ঋণের তথ্য এখনো ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কৃত্রিম লাভ দেখিয়ে কোনোমতে টিকে আছে। কোনো কারণে যদি বিপর্যয় শুরু হয়, তাহলে একটির পর একটি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াত্বের কবলে পড়বে, যার পুরো দায়িত্ব বর্তাবে সরকারের ওপর; যদিও ভুক্তভোগী হবে সাধারণ জনগণ। সংশ্লিষ্ট সব মহলের বারবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সরকারের কানে পানি তো ঢুকছেই না; বরং তাদের নিত্যনতুন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দিন দিন পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।
আমাদের দেশীয় অর্থনীতির এই মুহূর্তের প্রধান সমস্যা হলো মোটা মাথার দুর্নীতিবাজ নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরা। তারা বিদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বগল বাজায়, সেই অর্থে বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং বিদেশী পণ্যের ভোক্তা সৃষ্টি করে এই বলে উল্লাস প্রকাশ করে যে, দেশেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অন্য দিকে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও নব্য ধনীদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করে বাজেটের খরচ সামাল দিতে গিয়ে একবারও ভাবছে না, অনাগত দিনে কী হতে যাচ্ছে! দেশের এই মুহূর্তের বার্ষিক বাজেট প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। গবেষকগণের মতে, বাজেটের আনুমানিক ১০ শতাংশ অর্থ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কেবল বাজেট থেকে ব্লাক মার্কেটে চলে যায়। এর বাইরে সরকারি ক্রয়, আর্থিক লেনদেন, কমিশন, বেসরকারি খাত, লুটপাট, ভিওআইপি, শেয়ার মার্কেট, ঘুষ, চোরা কারবার, মাদক ব্যবসা, টাকা ও অস্ত্র পাচার, আদম পাচার, হুন্ডি, অভিবাসন প্রভৃতি খাতে কমপক্ষে দুই লাখ কোটি টাকা দেশী-বিদেশী দুর্নীতিবাজদের পকেটে প্রতি বছর চলে যায়। এসব কালো টাকার অবৈধ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে ব্যাংকগুলো কোনোমতে টিকে রয়েছে। অন্যথায়, শিল্প-বাণিজ্যের যে অবস্থা তাতে, বেশ আগেই অনেক ব্যাংক দেউলিয়াত্ব বরণ করত।
কালো টাকা লেনদেনের মতো ঝুঁকিহীন অসৎ পন্থা হাতের কাছে থাকায় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের পথে এগোচ্ছে না। ফলে দেশে গত সাত বছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো শিল্প-কলকারখানা স্থাপিত হয়নি। যেসব শিল্প মালিকেরা ব্যাংকের টাকায় বড় বড় শিল্প কলকারখানা গত ৮-১০ বছর আগে চালু করেছিলেন, তারাও নতুন কোনো প্রকল্প বা পুরনো শিল্প বিএমআরই করতে ঋণ পাচ্ছেন না। উল্টো চলমান প্রকল্প নিয়ে নানামুখী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ব্যাংকিং সেক্টরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিচালক এবং চেয়ারম্যানদের প্রায় সবাই একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট দিয়ে নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হচ্ছেন। নীতিনির্ধারণী মহলের কেউ কেউ বিষয়টি বুঝলেও পরিস্থিতির কারণে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারছেন না।
ব্যাংকিং সেক্টরের প্রথম সমস্যাটি শুরু হয় বর্তমান সরকারের গতবারের আমলে সৃষ্ট শেয়ার কেলেঙ্কারি থেকে। বলা হয়ে থাকে, শেয়ার মার্কেটে কারসাজির মাধ্যমে জুয়াড়িরা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। দেশের সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট ধুরন্ধর প্রকৃতির একটি মুখচেনা সিন্ডিকেট মাত্র এক বছরের মধ্যে এই বিশাল অঙ্কের টাকা শেয়ার মার্কেট থেকে তুলে নেয় এবং পুরো টাকাই দেশের বাইরে বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পাচার করে। এই সময়ে শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে সরকার কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কমিশন রিপোর্ট দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হাজার হাজার কমিশনের মধ্যে একমাত্র ইব্রাহিম খালিদের কমিশন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সব রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে সত্য ও বাস্তব ঘটনার নিরিখে প্রজ্ঞা ও মেধা খাটিয়ে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপট, কারণ এবং দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে রিপোর্ট দেয়।
অর্থমন্ত্রী বরাবর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার পর সারা দেশে আবার হইচই পড়ে যায়। রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়, কিভাবে সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া কাগজপত্রের বিপরীতে এবং ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে গিয়ে পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। রিপোর্টে কারসাজির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে তাদের অপকর্মের ধরন ও প্রকৃতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী রিপোর্ট পাওয়ার পর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, উল্টো মন্তব্য করে বসেন, ওরা অত্যন্ত শক্তিশালী। সরকার বিগত দিনে এসব কেলেঙ্কারির নায়কদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো পৃষ্ঠপোষকতা দিলে ব্যাংকগুলো তাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কৃত অনিয়মগুলো ধামাচাপা দেয়ার নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
যেসব ব্যাংক শেয়ার মার্কেটে বিপুল পরিমাণ পুঁজি হারায় তারা তাদের বার্ষিক অডিট রিপোর্টে সে কথা বেমালুম চেপে যায়। বিষয়টি যেহেতু ওপেনসিক্রেট, সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগ ব্যাংকগুলোর ত্রুটিপূর্ণ অডিট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে ব্যাংকগুলোকে সময় নিয়ে দেনাগুলো সমন্বয় করার সুযোগ দেয়। ফলে এ ঘটনার সাথে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা, পরিচালকেরা এবং সংশ্লিষ্ট বাইরের লোকজন নতুন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। তারা কৃত অনিয়ম, জাল জালিয়াতি ধামাচাপা দেয়ার কথা বলে পুরো ব্যাংক এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগকে জিম্মি করে ফেলে। এই সিন্ডিকেটই বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ, বদলি ইত্যাদি সব কর্ম এই সিন্ডিকেটের কথা মতো পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অনেকটা সাক্ষীগোপালের মতো। কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর নিয়োগ এবং পুনঃনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক শত চেষ্টা করেও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত রদ করতে পারেনি।
এই সেক্টরে দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, সভাপতি নিয়োগে অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান পরিচালক নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে। বাকিরা একদম থোড়াই কেয়ার করছে। অন্য দিকে, সরকারি ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মূলত সাক্ষীগোপালের ভূমিকা ছাড়া কিছুই করছে না। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট অদক্ষ, অব্যবসায়ী এবং নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যাংক পরিচালকেরা যে কতটা সর্বনাশ করতে পারে তা বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ এবং হলমার্ক কেলেঙ্কারির দিকে তাকিয়ে একজন বোকা মানুষও খুব সহজেই সব কিছু বুঝে নিতে পারবে।
সরকারি ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন পরিচালক এবং চেয়ারম্যানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। নিয়োগ লাভের আগে তাদের কোনো বাড়ি-গাড়ি ছিল না। ব্যবসা বাণিজ্যও ছিল না। রাজনৈতিক টাউট এবং সুবিধাভোগী হিসেবে তারা বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিস আদালতে ধরনা দিত। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যাংকিং সম্পর্কে তাদের কোনো বাস্তব জ্ঞানও ছিল না। ব্যাংকিং খাতের সিন্ডিকেটের কল্যাণে তারা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভের অতি অল্পকালের মধ্যে- নিজেদের ভাগ্য সফলতার স্বর্ণশিখরে নিয়ে যান।
গাড়ি-বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, বিশ্বের নামকরা শহরে ফ্ল্যাট, ভিলা ক্রয়সহ উচ্চাকাক্সক্ষার সব সোপানের স্বাদ চেখে দেখার জন্য তারা ব্যবসায়ী নামধারী টাকা পাচারকারী ব্যাংক লুটেরাদের সাথে হাত মেলায়। ফলে দেশ-বিদেশের প্রাসাদকেন্দ্রগুলোতে উড়তে থাকে বাংলাদেশের আমানতকারীদের অর্থ। মদ-মাংস এবং সাফল্যে ডুবে গিয়ে দুর্বৃত্তরা ঘটাতে থাকে একের পর এক কেলেঙ্কারি।
চলতি হিসাব এবং বিভিন্ন আর্থিক রিপোর্টে ব্যাংকগুলো দেখাচ্ছে, তাদের হাতে প্রচুর অলস অর্থ পড়ে রয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা বিরাজ করায় তারা তাদের বিপুল অঙ্কের অলস অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ দিকে ব্যবসায়ীরা শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হলে নানা অজুহাতে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অন্য দিকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অর্থের অভাবে আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিধায় বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে বিদেশী ব্যাংকের আমদানি বিল পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্ট দেশীয় ব্যাংকগুলোকে নোটিশ দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে এর আগে সরকার বিরাট অঙ্কের ঋণ নিত। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সরকার সেই ঋণ নিচ্ছে না মূলত জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে আশাতীত মুনাফা লাভের কারণে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাজেটের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শেষে গিয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হবে এবং তখনই দেখা দেবে প্রকৃত সমস্যা।
আমাদের অর্থনীতি এই মুহূর্তে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য এবং বিলাস দ্রব্যের আমদানি, বিপণন, পরিবহন এবং ভোগের মধ্যেই আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরপাক খাচ্ছে। শিল্প, কলকারখানা, কৃষি, আবাসন, ভৌতিক অবকাঠামো নির্মাণে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কালো টাকার আধিক্য এবং সেগুলোর অনিয়ন্ত্রিত স্থবির বিনিয়োগে দেশের কৃষিজমি, বনভূমি, নদী-নালা, খাল-বিল-ঝিল উজাড় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎপাদনমুখী এবং উন্নয়নমুখী না হয়ে ভোগবাদী সর্বনাশের দিকে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজেরা উল্লাসনৃত্য করলেও দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা, অসংখ্য ব্যবসায়ী পদে পদে হয়রানি, অবমাননা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছেন। ফলে অনাগত দিনে বাংলাদেশকে একটি কঠিন অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবেলা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।