খোলা বাজার২৪ ॥ বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৫: রাজধানী ঢাকায় এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা গত আট বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এডিস মশাবাহিত এ রোগে এ বছর প্রায় ২ হাজার ৬০০ জন আক্রান্ত হয়েছে। যদিও দুই মেয়রেরই নির্বাচনের আগে অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে ছিল মশা নিধন। গতকাল বুধবারও রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৮০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬০১ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, এর আগে ২০০৬ সালে ২ হাজার ২০০ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৭৪৯ জন পর্যন্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা শহর এক হাজারের বেশি ক্লিনিক ও হাসপাতাল আছে। তাঁরা পাচ্ছেন ২৫টি হাসপাতালের তথ্য। ফলে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ বলে তাঁদের আশঙ্কা।
সূত্র: আইইডিসিআররোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুস্তাক হোসেন বলেন, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই সচেতনতামূলক কাজ শুরু করা দরকার ছিল। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর মশা নিধনের উদ্যোগ নিলে চলবে না। তিনি আরও বলেন, এ বছরের আবহাওয়া এডিস মশার বংশ বিস্তারের জন্য খুবই অনুকূল ছিল। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি ছিল। আবার বৃষ্টি হয়েছে থেমে থেমে।
গত ২৮ এপ্রিল মেয়র নির্বাচনের আগে ঢাকার দুই মেয়রই বলেছিলেন, ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা মশা। উত্তরের মেয়র আনিসুল হক গত ২০ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকা উত্তরের ৩৬টি ওয়ার্ডের ৭৬ হাজার ৭৩৫ জনের কাছে তাঁদের জনজীবনে সংকট, সমস্যা নিয়ে তিনি একটি জরিপ করিয়েছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছিলেন ঢাকার প্রধান সমস্যা মশা। তিনি নির্বাচিত হতে পারলে নিয়মিত মশকনিধনের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন।
গত ১২ এপ্রিল দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। তাতে তিনি মশার উপদ্রব বন্ধ করা এবং মশা জন্মানোর স্থানগুলো সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দের প্রায় দ্বিগুণ। ডিএসসিসির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ সাড়ে ১২ কোটি টাকা, গত অর্থবছরের প্রায় সমান। মশক নিয়ন্ত্রণে উত্তরে কর্মী আছেন ২৭৯ জন এবং দক্ষিণে কর্মী আছেন ২৮৪ জন। করপোরেশন সূত্র বলছে, যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ হলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ যথেষ্ট ও সময়োপযোগী ছিল না বলে মনে করেন উত্তর ও দক্ষিণের কমপক্ষে পাঁচজন কাউন্সিলর।
উত্তরের একজন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সত্য কথাটা আমরা সব সময় বলতে পারি না। উচিত ছিল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। হয়নি। তিন-চার দিন আগে র্যালি হয়েছে।’ কাউন্সিলর হিসেবে কী করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি করলে বলবে, আগ বাড়িয়ে কাজ করে। এ আবার নতুন কোন বুদ্ধিজীবী?’
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণের একজন কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি নিজে হ্যান্ডবিল বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি। রোড শো হয়েছে। বাউল গানের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মশা মারার ওষুধ ছিটিয়েছি। মেয়র সাহেব নতুন মানুষ। কাজটা শুরু করতে তিনি একটু দেরি করেছেন।’
ঢাকা উত্তরে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা হয়েছে ১৮ অক্টোবর। উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ আহসান বলেন, ‘আমরা আসলে সচেতনতা বাড়াতে আরেকটা র্যালি করব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু নভেম্বর থেকে প্রকোপ এমনিতেই কমে আসার কথা।’ তবে তিনি দাবি করেন, যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উত্তরের। অনেকগুলো বৈঠক করে, বিজ্ঞপ্তি দিয়েই তাঁরা সুফল পেয়ে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
সিটি করপোরেশনের কাজ সম্পর্কে উত্তরের বাসিন্দা মো. সুলতান বলেন, তিন-চার বছর আগে দেখতাম মশা মারার ওষুধ ছিটাতে। ইদানীং দেখি না। দক্ষিণের লালবাগ এলাকার বাসিন্দা রাহুল রাহা বলেন, ‘আমরা মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। কিন্তু বিকেলে মেয়েকে যখন স্কুল থেকে আনতে যাই, তখন দেখি মশা মারার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তাহলে মশা কমছে না কেন?’
মশা না কমা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন রেজা খান বলেন, মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি গুদাম থেকে ওয়ার্ডে পৌঁছানোর পর মান ঠিক থাকছে কি না, সেটা দেখা হয় কি না, খতিয়ে দেখা দরকার। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের যে কর্মীরা মশা নিধনের কাজ করেন, তাঁরা এডিস মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানেন কি না, তা-ও দেখা দরকার। এডিস মশা নর্দমা বা নোংরা জায়গায় থাকে না। কিন্তু যেখানে নতুন ভবন উঠছে, সেখানে রাখা পাত্রে পানি জমে থাকতে পারে। তাঁর প্রশ্ন, সেখানে কি ওষুধ ছিটানো হচ্ছে?
উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, সিটি করপোরেশনের নয়, এমন অনেক এলাকায় মশা জন্ম নিচ্ছে। তাই শুধু সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন দেশের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, দক্ষিণের রোগী উত্তরে যাচ্ছে, উত্তরের রোগী দক্ষিণে আসছে। এভাবে উত্তর-দক্ষিণ ভাগ করা যাবে না। উত্তরের গুলশান, বারিধারার মতো কিছু এলাকাতেই ডেঙ্গু বেশি হয়েছে।