খোলা বাজার২৪ ॥ শনিবার, ৭ নভেম্বর ২০১৫: আড়াই দশকের বেশি সময় পরে মিয়ানমারে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক যাত্রার অপেক্ষায় নতুন রঙ চড়েছে কাউমোর বাসিন্দাদের মনে।
ইয়াঙ্গুন থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত শহর থেকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অং সান সু চি। গত ২৬ বছরের অধিকাংশ সময় গৃহবন্দিত্বে কাটানো প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডির চেয়ারপারসনের হাত ধরেই গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তি পাবে বলে মনে করেন এই শহরের বাসিন্দাদের অনেকে।
৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ভোটের দুদিন আগে শুক্রবার কাউমো শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সু চির জয়জয়কার। তাদের নেত্রী (বর্মি ভাষায় ‘গোয়াং সোয়াং’) মিয়ানমারের পরবর্তী সরকার প্রধান হবেন-এই প্রত্যাশায় দিন গুণছেন এলাকার বাসিন্দারা।
শহরের ট্যাক্সিচালক সি সেইন বলেন, “মিয়ানমারের গণতন্ত্রের ঘণ্টা বাজিয়েছেন সু চি। সেই দীর্ঘ পথের অভিযাত্রায় এদেশের গণতন্ত্রের শান্তির পায়রা আবার উড়াবেন তিনিই। আমরা এই প্রতীক্ষায় দিন নয়, সময় গুনছি মাত্র। আমাদের কাছে ৮ নভেম্বর একটি স্বপ্নের দিন। বিজয় সু চির হবেই হবে।”
২০১২ সালের উপনির্বাচনে এই আসন থেকে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছিলেন সু চি। ভোট পেয়েছিলেন ৬২ দশমিক ৭ ভাগ। এবার তার চেয়ে বেশি ভোটে জিতবেন বলে আশা করছেন তার সমর্থকরা।
প্রকৌশলী সো মো টু বলেন, “সু চি আমাদের এলাকার মেয়ে হিসেবে আমাদের কাছে অন্যরকম গর্ব। তাকে দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে কাউমোর একটি ভোটও অন্য কোথাও পড়বে না বলে আমার বিশ্বাস।”
শেষ প্রচারণায় সু চি কাউমো ছিলেন না, ছিলেন ইয়াঙ্গুনে। তিনদিন আগে এই কাউমো এসেছিলেন তিনি।
দুপুরে কাউমো বাজারে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় নারীরা নানা সাজে সেজে সু চির পক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করছেন। এই শোভাযাত্রায় ট্রাকে চড়ে বাদ্যযন্ত্র ও তবলার তালে তালে বর্মী ভাষায় স্থানীয় শিল্পী গান গেয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ছেন। ঘর থেকে মা-বোনদের সঙ্গে শিশুদেরও বেরিয়ে এসে করতালি দিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন জানাতে দেখা গেছে।
কাউমো শহরের সড়কে অং সান সু চির পক্ষে শোভাযাত্রা কাউমো শহরের সড়কে অং সান সু চির পক্ষে শোভাযাত্রা নির্বাচনী প্রচারণায় এখানে পোস্টার-তোরণ কিংবা ডিজিটাল ব্যানারের তেমন সমারোহ দেখা যায়নি। রাস্তার ধারে নির্ধারিত স্থানে এক/দুটি প্রার্থীর ছবি সম্বলিত ব্যানার এবং দলীয় পতাকা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। শহরের মতো গ্রামেও নির্বাচনী বিধি মেনে চলতে দেখা গেছে দলগুলোকে। রাস্তা বন্ধ করে মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায়নি কাউমোর শেষ দিনের প্রচারণায়।
‘কাই তাও’ গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, “আমাদের প্রচারণায় নিয়ম মানা হচ্ছে ধর্ম। সরকারের কঠোর নজরদারি আছে। তারপরও আমরা সচেতন সু চির ব্যাপারে। আমরা তার বিজয়ের প্রতীক্ষায় সময় গুণছি। শেষ প্রচারণার শোভাযাত্রায় তার প্রতিধ্বনি শুনছি। জয় সু চির, জয় গণতন্ত্রের হবেই।”
সু চির বিপক্ষে কাউমোতে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি-ইউএসডিপির ইউ কিন সোয়ে।
ইউএসডিপির জনসমর্থন কম হলেও প্রচারণায় পিছিয়ে নেই তারা। কাউমোর রাস্তার ধারে দলীয় পতাকা ও তাদের প্রার্থীর ব্যানার টাঙানো রয়েছে। শেষ প্রচারণায় দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নেমে শোভাযাত্রা করতে দেখা গেছে।
সু চির জন্ম ১৯৪৫ সালে, ইয়াঙ্গুনে। বাবা জেনারেল অং সান মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। মা দেও কিন চি ১৯৬০ সালে দিল্লিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সু চি লেখাপড়া করেছেন দিল্লি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে। দর্শন, অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতে উচ্চতর শিক্ষা নেন তিনি। যুক্তরাজ্যে সে দেশের নাগরিক আলেজান্ডারকে বিয়ে করেন, স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘদিন লন্ডনে বসবাস করেন।
মায়ের অসুস্থতায় পাশে থাকতে ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে ফিরে আসেন সু চি। ওই সময় স্বৈরশাসক জেনারেল নে উইনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে নতুন যাত্রা শুরু হয় তার। ১৯৮৯ সালে সু চিকে গৃহবন্দি করে সামরিক সরকার।
সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর সামরিক একনায়তন্ত্রের অধীনে ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল এনএলডি। সামরিক জান্তা নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় ক্ষমতাগ্রহণ তো দূরে থাক, গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি মেলেনি সু চির।
১৯৯১ সালে সু চি শান্তিতে নোবেল পেলে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নেত্রী (গোয়াং সোয়াং) হয়ে ওঠেন তিনি। তার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও কিছুটা শিথিল হয়।
২০১০ সালে সামরিক জান্তার অধীনে পার্লামেন্ট নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১২ সালে উপ-নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বে এনএলডি অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে।
সু চি পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা হওয়ার পর ছোট শহর কাউমো শুধু মিয়ানমার নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত একটি নাম হয়ে ওঠে।
ইরাবতী নদকে ঘিরে পলিমাটির ব-দ্বীপে কাউমো শহর। সবুজ প্রকৃতি ঘেরা এই জনপদ।
তান মু হাউজ, নাট সিন কন এবং কেইল্ক থ্যা লি- এই তিনটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এখানকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। অধিবাসীরা অনেক পরিশ্রমী। পলিমাটিতে দুই ফসল হয়। ধানই প্রধান ফসল। ছনের ঘরের পাশাপাশি সবুজ টিনের কাঠের ঘর রয়েছে।
মেয়েরা দোকানে কাজ করেন। বাইসাইকেল যাকে স্থানীয়ভাষায় ‘সাবি’ বলা হয়, তাই তরুণীদের প্রধান বাহন। এর বাইরে ‘সাইকা’ নামে এক ধরনে রিকশায় চলাচল করে মানুষ।
তেমন প্রাচীন নিদর্শন না থাকলেও শোকের ইতিহাস রয়েছে কাউমোয়। ২০০৮ সালের মে মাসে প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’র আঘাতে ছোট্ট এই শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এই অঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
শহরে লাল মাটির অলি-গলি সড়ক। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধ।
বৌদ্ধ ভিক্ষু উ মম সুই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। কাউমোর মানুষ বিশ্বাস করে, প্রেসিডেন্ট না হতে পারেন, কিন্তু সু চির হাতেই থাকবে ক্ষমতার চাবি।”
ভোটে এনএলডি জিতলেও বিদেশিকে বিয়ে করায় মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না সু চি। তবে তিনি বলেছেন, দল জিতলে রাষ্ট্রপতির চেয়ে বড় কিছু হবেন তিনি।