খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৫: ফেসবুক যেন ‘ফ্রেন্ড’ শব্দের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে দিয়েছে। এই বন্ধু এমন একজন, যার সঙ্গে হয়তো জীবনে একবারই দেখা হয়েছে। (সূত্র: স্কুপ এম্পায়ার ডটকম)।
এরপরেও কিন্তু জীবনে এই ভার্চ্যুয়াল বন্ধু, ছায়াবন্ধু কিংবা ছায়াসঙ্গীরা ব্যাপক গুরুত্ব পায়। তাদের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে লিখে লিখে, স্কাইপে বা ভাইবারে কথা বলে কেটে যায় অনেকটা সময়। হয়তো প্রেম বা অন্য কোনো গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াও নয়, নেহাতই বন্ধুত্ব—তবে তা পুরুষের সঙ্গে নারীর কিংবা নারীর সঙ্গে পুরুষের। ভার্চ্যুয়াল সেই বন্ধুত্বে কারণে অনেক সময় বাস্তবের সঙ্গী উপেক্ষার শিকার হন।
আদিল রহমানের (ছদ্মনাম) কথাই ধরা যাক। সেই কবে, বছর বিশেক আগে ‘এমআইআরসি’ দিয়ে ইন্টারনেটে চ্যাটিংয়ের শুরু। প্রযুক্তির বিবর্তনে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের হাল আমলে এসেও সে অভ্যাস গেল না। পুরোনো বন্ধু যেমন আছে তাঁর, তেমনি জোটে নতুন নতুন বন্ধু। এমনও বন্ধু আছে কয়েকজন, যাদের সঙ্গে দেখাই হয়নি। কিন্তু স্মার্টফোনের পর্দায় ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রতিদিনই কথা, ছবি দেখাদেখি—ভাবের আদান-প্রদান দুর্বার। লিখে লিখে কথা বলায় এমনই দুর্দান্ত আকর্ষণ যে বাসায় ফেরার পর স্ত্রী সোনিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম) যখন কথা বলতে চান, তখনো আদিলের আঙুল ঘুরে বাড়ায় স্মার্টফোনের পর্দায়। খাবার টেবিলেও পাশে থাকে ফোনটি। বার্তা আসার শব্দে মনোযোগ চলে যায় ওদিকে। সোনিয়া প্রথম দিকে পাত্তা দিতেন না। কিন্তু নিজের সঙ্গীকে বাড়িতেও একান্তে না পাওয়ার দুঃখ ধীরে ধীরে ক্ষোভে রূপ নেয়। একদিন বলেই বসেন, ‘এই ফেসবুক তো আমার সতিন।’ যেদিন ভার্চ্যুয়াল বন্ধুদের কেউ অনলাইন থাকে না, সেদিন আহ্লাদী ঢঙে সোনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে যান আদিল। ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সোনিয়া আদিলের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ আর করতে পারেন না।
অনলাইনে এই যে ছায়াসঙ্গী, যে বাস্তবের সঙ্গীর চেয়ে বেশি ‘আপন’, তার সঙ্গে সম্পর্ক কি শুধুই প্লেটোনিক থাকে! কম হারে হলেও চ্যাটিংয়ে কথাবার্তা সীমা অতিক্রম করে। যেহেতু সম্পর্কটি বায়বীয়, তাই ব্যাপারটায় বাস্তবতা নেই। কিন্তু একধরনের অনুভূতি তৈরি হয়—সিমুলেশন। পশ্চিমা বিশ্বে এই বিষয় অনেক বাস্তব সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মার্কিন চিকিৎসক, আসক্তি বিশেষজ্ঞ ও গ্রন্থকার জেনিফার পি স্নেইডার ৯১ জন নারী ও তিনজন পুরুষের ওপর একটা জরিপ চালান। এতে দেখা গেছে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ দম্পতি এর ভুক্তভোগী। এই জরিপে এটাকে তালাকের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের কারণে এঁদের ৬৮ শতাংশ স্বামী-স্ত্রী শারীরিক সম্পর্কেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের দেশেও কি এর প্রভাব নেই? নানা ধরনের বাৎচিত চলার পরও মাঝেমধ্যে ভার্চ্যুয়াল বন্ধু কখনো কি একে অপরের প্রতি শারীরিকভাবে আকৃষ্ট হয় না? এর প্রভাব বাস্তব জীবনেও অবশ্যই পড়ে।
যুক্তরাজ্যে করা আরেকটি জরিপে দেখা গেছে ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের কারণে ৪০ শতাংশ দম্পতি নিজেদের স্বাভাবিক সম্পর্ক উপেক্ষা করছেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী বলেছেন, ‘আমার এবং আমার স্বামীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির কাজ করছে স্মার্টফোন।’
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আইন প্রতিষ্ঠান স্লাটার অ্যান্ড গার্ডন এর একটি জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এর কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের হার আগের থেকে বাড়ছে। (সূত্র: ডেইলি মেইল)
পাশে থাকা সঙ্গীকে অনেক সময় মনে হয় জৌলুশহীন। স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারের পর্দার ওপারে থাকা অদেখা, কম দেখা মানুষটিকে যেন বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। ‘কিন্তু আজ যদি আপনি কোনো বিপদে পড়েন, তবে ওই ভার্চ্যুয়াল বন্ধুটি আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। বাস্তবের সঙ্গী, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন আপনার পাশে এসে দাঁড়াতে পারবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন বললেন এ কথা। এই যে ভার্চ্যুয়াল বন্ধু বা বন্ধুদের পেয়ে বাস্তবের সঙ্গীকে উপেক্ষা করা, তা পুরুষ, নারী দুজনের বেলাতেই প্রযোজ্য মনে করেন তিনি। বললেন, ‘আগে বুঝতে হবে কী চাইছেন? দুজনের মধ্যে শূন্যতাটা কোথায়, এটা বের করতে হবে—যে কারণে মানসিক, শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে নিজে না বুঝলে কিছু করা যাবে না।’
যেকোনো এক সঙ্গীর একাকিত্ব অনেক সময় এ ধরনের ছায়াসম্পর্ক তৈরিতে ঠেলে দেয়। একজনের ব্যস্ততা, সময় না দেওয়া—এসবই তো কারণ। সুলতানা আলগিন বললেন, যদি সমস্যাগুলো বারবার তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হয়, তবে তিনি তা পছন্দ করবেন না। সময় নিয়ে তাঁকে বুঝতে হবে। বাস্তবের যে সঙ্গী, যে পরিবার, সেটাই কিন্তু প্রাইমারি ইউনিট—অগ্রাধিকার এখানেই। এরপর অন্য সব সম্পর্ক দ্বিতীয় ধাপে। দ্বিতীয় ধাপের জন্য প্রথমটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বাস্তব জীবনের সঙ্গী ও বন্ধুদের সময় দিতে হবে বেশি করে।
উন্নত ও সর্বগামী প্রযুক্তির কারণে এখন নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধবী পাওয়া এক ক্লিক কিংবা আঙুলের একটা স্পর্শের ব্যাপারমাত্র। সামাজিক যোগাযোগের বাংলাদেশি মাধ্যম বেশ তো ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর মনে করেন, সমাজে আসলে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য পরিপক্বতা দরকার। ‘আমাদের সমাজে হঠাৎ করে মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন আসায় অনেক সময় আমরা ঠিকমতো এর ব্যবহার করতে পারি না। উন্নত দেশগুলোয় ধীরে ধীরে সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে প্রযুক্তি। আমাদের জীবনযাপনের গতির চেয়ে প্রযুক্তির গতি অনেক বেশি। এ দুটো খাপ না খাওয়ায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই শুধু নয়, সন্তান, মা-বাবা, ভাইবোনের মধ্যেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।’
অনলাইনের বন্ধুত্ব একটা পর্যায় পর্যন্ত লালন করা উচিত। একে একধরনের বিনোদন বা সময় কাটানোর মধ্যে রাখলে বাস্তবের সঙ্গী আর নিজেকে উপেক্ষিত মনে করবে না। বাস্তবের সঙ্গী বা বন্ধুই কিন্তু এগিয়ে আসবে সুখে-অসুখে।