Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

5খোলা বাজার২৪ ॥ শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০১৫ : বাবার ভালোবাসার ফসল নয়; দখলদারদের যৌন নির্যাতনে জন্মের পর মা, মাতৃভূমির স্নেহ বঞ্চিত হলেও স্বদেশের প্রতি এক ‘যুদ্ধশিশুর’ মমত্বের কথা উঠে এসেছে তার মেয়ের কথায়।
একাত্তরে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শিখা জন্মের কয়েক মাসের মাথায় দত্তক হয়ে চলে যান কানাডায়। বেড়ে উঠেছেন সেখানে, এখন দুই সন্তানের জননী তিনি। দুই মেয়ের একজন ক্যাটরিনা কাপুচিনো শুক্রবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কথা শোনান।
“যদিও মাকে একজন কানাডিয়ান হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু একজন বাংলাদেশি অরিজিন হিসাবেই মা গর্ববোধ করেন।”
বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে তাকে বলা মায়ের কথা উদ্ধৃত করে ক্যাটরিনা জানান, “পৌঁছেই তুমি বাংলাদেশের মাটিকে চুমু দেবে।”
শিখার মতো ১৫ যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়ে বাহাত্তরে কানাডায় নিয়ে যান ফ্রেড ও বনি কাপুচিনো। স্বদেশে ‘অচ্ছুত’ যুদ্ধশিশুদের জীবন স্রোতে ফিরিয়ে আনার সেই কাহিনী শুনিয়ে শুক্রবার শ্রোতাদের আবেগাপ্লুত করেন বনি।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে আলাপচারিতায় বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কানাডিয়ান এই গৃহবধূর সঙ্গে ছিলেন ক্যাটরিনা।
বনি কাপুচিনো বলেন, দুর্ভাগ্যের শিকার শিখা, ওমর, ইমন, প্রদীপসহ ১৫ যুদ্ধশিশু বাংলাদেশে যখন সম্মান পাচ্ছিল না তখন তাদের পরিবারের ভালবাসা দিতে কানাডায় নিয়ে যান তারা।
এদের মধ্যে ১৪ জনকে বিভিন্ন পরিবারে দত্তক দিলেও তিন মাস বয়সী শিখাকে নিজের কাছেই রেখে দেন। আদর-স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করেন নিজের সন্তানের মতোই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করেন অনেক নারী, যাদের অনেকেই পাক সেনাদের নির্যাতন আর তৎকালীন সমাজের বিরূপ দৃষ্টির সামনে মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সন্তান লালন-পালনের মতো অবস্থায় তারা ছিলেন না।
সেই সময় আইন সম্মত না হলেও নির্যাতিত এমন নারীদের জন্য আইন শিথিল করে গর্ভপাতের অনুমোদন দেওয়া হয়। গর্ভপাতের সময় বেঁচে যায় এমন ১৫ শিশুর দুর্ভাগ্যের খবর জানতে পেরে তাদের দত্তক নিতে সুদূর কানাডা থেকে ছুটে এসেছিলেন বনি কাপুচিনো।
৮১ বছর বয়সী বনি বলেন, “সেই সময় আমি পড়লাম ১৫টি শিশুর কথা, গর্ভপাতের সময় যাদের জন্ম হয়েছে। তাদের এই দেশে গ্রহণ করা হচ্ছিল না। দুর্ভাগ্যের শিকার এই শিশুরা সম্মান পাচ্ছিল না। আমরা এই শিশুদের কানাডা নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম, এই শিশুদের এমন পরিবারে নিয়ে যেতে যেখানে তারা ওই পরিবারের শিশুদের মতোই বড় হবে, ভালোবাসা পাবে।”
ওই যুদ্ধশিশুদের ঢাকার তৎকালীন মাদার তেরেসা হোম থেকে কানাডা নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন সপ্তাহের বেশি ছোটাছুটি করতে হয়েছে বনি ও ফ্রেড দম্পতিকে।
তাদের কানাডা নিয়ে যাওয়ার জন্য পাসেপোর্টের দরকার ছিল। ১৯৭২ সালের ওই সময়ে ঢাকায় কানাডিয়ান হাই কমিশন ছিল না। দিল্লির কানাডিয়ান হাই কমিশনার তাদের কাছে ট্রাভেল ডকুমেন্ট চায় বলে জানান বনি কাপুচিনো।
“আমার স্বামী ফ্রেড তখন একটা করে ফরম পূরণ করল, সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের একটা করে ছবিও ছিল। কিন্তু হাই কমিশনের লোকেরা বলল, এটাতো ট্রাভেল ডকুমেন্ট নয়।
“এক পর্যায়ে আমার স্বামী আমাকে বলল, আমার কী করা উচিত? আমি জবাব দিলাম, সেটা আমি জানি না। তুমি এটা কর, ব্যস। সে করেছিল। যখন এই শিশুরা কানাডা যাওয়ার অনুমতি পেল, সেটা যে কী এক অভূতপূর্ব বিষয় ছিল!” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন বনি।
যুদ্ধশিশুদের কানাডা নিয়ে যাওয়ার এই গল্প শ্রোতাদেরও ছুঁয়ে যায়।
বাংলাদেশের সেই যুদ্ধশিশুদের একজনের সন্তান ক্যাটরিনা প্রথমবার দেশে আসায় অনুষ্ঠানে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনান সুমাইয়া ইকবাল। এই চিঠি শোনার সময় ক্যাটরিনাকে বারবার চোখ মুছতে দেখা যায়।
“এদেশের মানুষের উদারতায় আমি মুগ্ধ। আমার আজ মায়ের কথা, ছোট বোনটির কথা মনে পড়ছে। তারা যদি আজ আমার সঙ্গে এখানে থাকত!,” বলেন তিনি।
ছোটবেলায় বাবা হারানো ক্যাট থাকেন নানী বনি ও নানা ফ্রেড কাপুচিনোর সঙ্গে। সম্প্রতি স্নাতক শেষ করে তিনি কানাডায় সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন তিনি।
সময় নিয়ে বাংলাদেশ দেখতে আবারও আসতে চান একাত্তরের যুদ্ধশিশুর সন্তান ক্যাটরিনা। সেই সময় মা শিখাকেও নিয়ে আসতে চান নিজের শিকড়ে।
বাংলাদেশে এই সফরে বনি ও ক্যাটরিনার সঙ্গী হয়েছেন ছেলে রবিন হুড কাপুচিনো ও আরেক নাতি কাইনেন কাপুচিনো। নিজেদের দুই সন্তানের বাইরে বনি-ফ্রেড দম্পতি বাংলদেশি শিখাসহ ১৯টি সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন।
বনি-ফ্রেড যখন শিখাদের নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের ছেলে রবিন হুড কাপুচিনো তখন ছিলেন কানাডায়। দেখাশোনা করছিলেন ছোট ভাই-বোনদের, যাদের অনেকেই ছিল দত্তক।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধশিশুদের কানাডায় নিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন বনি কাপুচিনো স্বাধীনতার পর যুদ্ধশিশুদের কানাডায় নিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন বনি কাপুচিনো ১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া রবিন ভাই-বোন সবার মধ্যে বড়। বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের অনেক কিছুই তিনি স্মরণ করতে পারছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের এই কিশোর বলেন, “যুদ্ধের অনেক খবরই আমরা সেই সময় পাচ্ছিলাম। বিশেষ করে জর্জ হ্যারিসনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আমাকে ব্যাপকভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল।”
চট্টগ্রামে তার মায়ের প্রতিষ্ঠিত শিশু নিবাস ‘শিশু স্বর্গ’ দেখতে মাঝে মাঝেই বাংলাদেশে আসেন তিনি।
২১ ভাই-বোনের সংসারে বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে রবিন বলেন, “আমাদের পরিবার অন্য পরিবারগুলোর মতোই ছিল। আমরা একত্রে খেলতাম, খেতাম। আমাদের মাঝে বিরোধও লাগত।
“তবে একদিক থেকে আমরা বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলাম। আমাদের মা-বাবা সবাইকে নিজের নিজের সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই বড় করেছেন। তাই আমরা ছোটবেলা থেকেই ঘরে বসে বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে জন্য আমি খুবই গর্বিত।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ইমরান আজাদ বলেন, “যখন কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক আইন যুদ্ধশিশুদের সুরক্ষা দেয়নি, ওই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন বনি।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক খায়ের মাহমুদ বলেন, “ট্রাইব্যুনালের রায়, আইনগত ও ধারণাগত নানা অগ্রগতির পর এখন যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আলোচনা করা যতটা সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পর এটা ততোটা সহজ ছিল না। সেই পরিস্থিতিতেও বনি এগিয়ে এসেছিলেন।”
বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে যুদ্ধশিশুদের কথা তুলে ধরতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই দুই তরুণ।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী আমরা সমর্থন পেলেও সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় ছিল যুদ্ধশিশু। তাদের সমাজ গ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। সেই সময় ফ্রেড ও বনি দম্পতি এই শিশুদের দত্তক নেওয়ার ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসেন।
“এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া ছিল। এটা কেবল দত্তক নেওয়ার বিষয়ই ছিল না। এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয় ছিল। এজন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।”