খোলা বাজার২৪॥ রবিবার, ২৯ নভেম্বর ২০১৫ : বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী খান-এ-সবুরের নামে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় কী কী স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে- তার তালিকা চেয়েছে হাই কোর্ট।
রোববার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ খুলনার মেয়রকে ১৫ দিনের মধ্যে ওই তালিকা আদালতে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর এক আদেশে একই বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনতে আদালতের দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলেছিল। এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল সাত দিনের মধ্যে।
সে অনুযায়ী খুলনা সিটি করপোরেশনের আইনজীবী রোববার আদালতে প্রতিবেদন দিলেও তা যথাযথ হয়নি বলে জানিয়েছে আদালত। মেয়রকে ১৫ দিনের মধ্যে আবারও এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আদালত জানিয়েছে, আগামী ১৪ ডিসেম্বর বিষয়টি আবার তার্যতালিকায় আসবে।
আদালতে আবেদনকারীপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক। আর খুলনার মেয়রের পক্ষে ছিলেন এম এ গফুর।
আদেশের পর রাশেদুল হক বলেন, “মেয়রের প্রতিবেদন যথাযথ হয়নি। কারণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামলার পক্ষ না হয়েও অন্য একজনকে প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, যা আইনানুগ হয়নি বলে আদালত মনে করেছে।”
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নাম প্রত্যাহারের আদেশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না, তাও প্রতিবেদন আকারে জানাতে বলেছিল এই বেঞ্চ।
এ বিষয়ে রাশেদুল হক বলেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে আদেশ প্রতিপালন করেছে বলে জানিয়েছে।”
মুসলিম লীগের নেতা খান-এ-সবুর পাকিস্তান আমলে ছিলেন আইয়ুব খানের মন্ত্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে বিচার শুরুর সময় প্রকাশিত ছয়শ স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীর তালিকাতেও তার নাম ছিল। সেই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের নামেই পরে যশোর রোডের নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ থেকে কলকাতার দমদম পর্যন্ত এই সড়ক ধরেই একাত্তরে লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। তাদের দুর্দশা দেখেই আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, যা সে সময় বিশ্বকে নাড়া দেয়।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক হয়েই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে শত্রুমুক্ত যশোরে পৌঁছান।
সড়ক ছাড়ও খান-এ-সবুরের নামে কয়েকটি স্কুল ও মাদ্রাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে খুলনায়।
জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ষাটের দশকে মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে ১৯৭২ সালে তাকেও দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তার নামেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিলনায়তনের নামকরণ হয়।
স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনা, সড়ক, অবকাঠামোর নামকরণ স্থগিত চেয়ে ২০১২ সালে হাই কোর্টে একটি রিট করেন মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবীর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৪ মে রুলসহ খান-এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমানের নাম ব্যবহার স্থগিতের অন্তর্বতীকালীন আদেশ দেয় হাই কোর্ট।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের নামে থাকা সড়ক, স্থাপনা ও অবকাঠামোর নাম পরিবর্তনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সেসবের নামকরণ কেন করা হবে না এবং যারা ওই নামকরণের জন্য দায়ী, তাদের কেন বিচারের আওতায় আনা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
আদালতের ওই নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না জানিয়ে গত ২৫ অগাস্ট আরেকটি আবেদন করেন মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির।
এরপর হাই কোর্ট যে আদেশ দেয়, তাতে ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ব্যবহার করতে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নামও প্রত্যাহার করতে বলা হয়।
এরপর ১ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘সব খানে সবুর খানের ভক্ত?’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন রোববার আদালতের নজরে আনেন আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরও যুদ্ধাপরাধীদের নাম সরানোর কাজে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে শুনানি করেই ৩ নভেম্বর সাত দিনের মধ্যে ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনার আদেশ দেয় আদালত।